।। গোলেমালে গোলেমালে ।।
অরিন্দম নাথ
আজ একদমই ভণিতা করবো না । আপনারা যারা আমার লেখার সাথে পরিচিত, তাঁরা অবগত আছেন যে আমার লিভার থেকে সময় সময় এক বিচিত্র এনজাইম ক্ষরণ হয় ৷ এই জারক-রসের সংস্পর্শে, শর্করা জাতীয় খাবার মদ্যে পরিণত হয় ৷ ফলে অজান্তেই আমি বেশ নেশার আমেজ পাই ৷ মৌতাত আসে । এমনি মৌতাতের মুহূর্তে প্রায়ই হাজির হয়ে যাই বিধাতার দরবারে ৷ সত্যিকথা বলতে কি করানোর ভয়ে, বইমেলার পর থেকেই স্যোসিয়েল ডিসটেন্স জারি করেছিলাম । ফেইসবুক ডি-এক্টিভেট করে রেখেছিলাম । এখন যা পরিস্থিতি, ডান হাত বা হাতকে বিশ্বাস করে না । কখন বদন কিতাবের পোস্ট দেখতে দেখতে গোঁফে তা দিতে ইচ্ছে হয় ! আর তা হলেইতো বিপত্তি ।
লক-ডাউন ঘোষণার পরের দিন রাতের অভিজ্ঞতা । মৌতাত এলো । আর তখনই পৌঁছে গেলাম শূন্যে ভাসমান বিধাতার দরবারে । বিশাল সুদৃশ্য ভবন ৷ যেন বিশালাকার বিমানবন্দর । কিন্তু একদমই শুনশান । বিধাতার চেম্বার আমি চিনি । অন্যদিন শুম্ভ-নিশুম্ভকে পেতাম । আজ মানিকজোড়ের দেখা নেই । প্রকৃত অর্থেই লক-ডাউন । বিধাতাকে পেলাম ৷ বিচিত্র পোশাকে । গোলাকার আকৃতির একটি অ্যাটায়ারে । হলদেটে রং । যেন সূর্যের করোনা। সূর্যের বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তরকে করোনা বলে । তবে ম্লান আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে । তাই রক্ষে । অন্যথায় চোখ ধাঁধিয়ে যেত । আমার সাড়া পেয়ে বিধাতা আমার দিকে তাকালেন। একটু মুচকি হাসলেন । আমার মুখ-ফসকে বেরিয়ে গেল, "বিধাতা! আপনি এই পোশাকে ?"
- বিষে, বিষক্ষয় । করোনা রুখতে করোনা জ্যাকেট ।
- সে আবার কি?
- হ্যাঁ, করোনা জ্যাকেট । এই জ্যাকেটে সূর্যের করোনার সব কয়টি মৌল যেমন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অক্সিজেন, কার্বন, লোহা, নিয়ন, নাইট্রোজেন, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার ইত্যাদি উপকরণ আছে । করোনার বিরুদ্ধে প্রোটেকশন দেয় ।
মুহুর্তের জন্য আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম । কলেজের প্র্যাকটিক্যালের দিনগুলোর কথা মনে এলো । প্রতিটি মৌল গ্যাসীয় অবস্থায় আলাদা আলাদা আলাদা বর্ণের আলো বিচ্ছুরণ করে । স্প্যাক্ট্রোমিটারে সূর্যের আলোর বিশ্লেষণ করতাম । এই বর্ণ আসলে সাদা । পৃথিবীর পরিবেশে বিচ্ছুরণের কারণে হলুদ দেখায় । বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে বিধাতাকে প্রশ্ন করি, "এই জ্যাকেট নিশ্চয়ই খুব ভারী ?"
- একদমই না । নিরানব্বই শতাংশ হচ্ছে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম । হাইড্রোজেন চুয়াত্তর শতাংশ । হিলিয়াম পঁচিশ শতাংশ । বাকি একভাগ অন্য মৌল ।
- আপনি শুধু আপনার নিজের কথাই ভাবলেন ! আমরা মর্ত্যের বাসিন্দারা বাঁচব কি করে ?
- মাভৈঃ ! সূর্যের করোনা থেকে নিঃসৃত তাপ করোনা অসুরকে শেষ করবে ।
- আপনার আবাস আজ এতো ফাঁকা ফাঁকা কেন? চিত্রগুপ্তের দপ্তরও দেখছি বন্ধ ! শুম্ভ-নিশুম্ভই বা কোথায় ?
- দেবতারা সবাই করোনা অসুরের ভয়ে সেল্ফ কোয়ারেনটাইনে । চিত্রগুপ্তের বয়স হয়েছে । তাঁর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । তিনি অজানা স্থানে বসে অন-লাইনে অফিস করছেন । শুম্ভ-নিশুম্ভই এদিকের অফিস সামলাচ্ছে । তুমি তো জানো ওরা একবার মারা গিয়েছে । তাই তাদের মৃত্যুভয় কম । তবে প্রোটেকশন নিচ্ছে । ওরাইতো এই করোনা জ্যাকেট ডিজাইন করেছে। ছেলেদুটি ভীষণ কাজের । একটি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেছিল । অন্যটি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ছিল ।
আমাকে পেয়ে বিধাতা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন । এই কয়দিন সম্ভবতঃ কথা বলার কাউকে পাচ্ছিলেন না । আমি বললাম, "শুম্ভ-নিশুম্ভ এখন কোথায় বসে ?"
- চলো, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ।
আমি বিধাতার পেছন পেছন চলতে থাকি । এক মিটার থেকে অনেকটা বেশি দূরত্ব বজায় রেখে । আমার ভয়, ক্ষেপে গিয়ে আমায় যদি তিনি ভষ্ম করে দেন । তিনি আমায় নিয়ে একটি ল্যাবরেটরিতে ঢুকেন । কোথাও একটা মিউজিক সিস্টেম আছে । সেখান থেকে গান বাজছে ।
"না, না গো না,
কোরো না ভাবনা--
যদি বা নিশি যায় যাব না যাব না ॥
যখনি চলে যাই আসিব ব'লে যাই,
আলোছায়ার পথে করি আনাগোনা ॥"
শুম্ভ-নিশুম্ভ দুটো চেয়ারে বসে আছে । তাদের চারদিকে একটি কিউবিকল । এর বাইরে করোনা জ্যাকেট । আগেও কয়েকবার শুম্ভ-নিশুম্ভের সাথে দেখা হয়েছে । তখন দাড়োয়ানের ভূমিকায় দেখেছি । এখন দেখে মনে হচ্ছে সায়েন্টিস্ট । মানিকজোড় যে বাঙালি, কখনও মনে হয়নি । বিধাতা তাদের বললেন, "দেখো কাকে নিয়ে এসেছি !"
দৃশ্যত আমাকে দেখে মানিকজোড় খুশি হলো । আমি বললাম, "আপনারা বাঙালি?"
- হ্যাঁ, আমরা বাঙালি । তবে শখের বশে গান শুনছি না ।
বিধাতা ইন্টারাপ্ট করলেন, "তোমরা বরঞ্চ ওকে তোমাদের বর্তমান কাজ সম্পর্কে বুঝিয়ে বল।"
বিধাতার কথায় মানিকজোড়দের একজন সরব হয় , "দেখো আমরা এখন চিত্রগুপ্তের অফিস স্টাফ । এখন প্রচুর লোক করোনা ভাইরাসের প্রকোপে মারা যাচ্ছে । মানুষ মারা গেলে আত্মা এখানে আসে । মডুলেটেড সিগন্যালের মত । এর বাইরে একটি অবয়ব থাকে । যেন ক্যারিয়ার সিগন্যাল । খালি চোখে তা দেখা যায় না । করোনা ভাইরাসে মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ল্যারিংস বা স্বরনালিতে এর রেশ থেকে যায় । আমরা ডি-সাইফার করার যন্ত্র বানিয়েছি । যারা করোনায় মারা গিয়েছেন তাঁদের স্বরযন্ত্রে 'করোনা' শব্দটির রেশ থাকে । গানের মধ্যে 'করো না' হিসেবেও আসতে পারে । আসলে করোনা ভাইরাস আমাদের স্বরনালিতে বাসা বাঁধে । শ্বাস প্রশ্বাসের বাঁধার সৃষ্টি করে । করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মৃত মানুষদের আত্মাকে এখানে চৌদ্দ-দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় । পরে চিত্রগুপ্ত স্যার এসে বিধান দেবেন । অনেক গান বোধগম্য হয় না । তবে করোনা শব্দটি স্পষ্ট বুঝা যায় ।"
শুম্ভ কিংবা নিশুম্ভ, যেই হোক, একটু দম নেয় । ততক্ষণে রবীন্দ্র সংগীত থেমে গেছে । আমি বুঝতে পারি, 'না, না গো না,কোরো না ভাবনা--', এই গানের লিপিতে 'করো না' শব্দটি এসেছে । তবে বিযুক্ত হয়ে । বিধাতা এবার কথা বলেন, "তুমি ওকে আরও কিছু ডি-সাইফার ভয়েস শুনিয়ে দাও ।"
আবার সাউন্ড সিস্টেম সরব হয় :
"বাশেঁর নিন্দা কেউ করোনা
করো বাশেঁর চাষ
কারন,,,,,,,,,,,,,,,
এক গুরু মাতা পিতা
আরেক গুরু বাশঁ,,,,,,,।"
বিধাতা আমায় প্রশ্ন করেন, "তুমি কী গানটি আগে শুনেছ?"
আমি মাথা চুলকে, না বলি। মানিকজোড়দের একজন উত্তর দেয়, "আমি পিন্টুদাস বাউলের কণ্ঠে গানটি শুনেছি ।"
পরের গানটি আমার কমন পড়ে :
"সুন্দরী গো, দোহাই দোহাই, মান করো না,
আজ নিশীথে কাছে থাকো, না বোলো না ।।"
আমি হাততালি দিয়ে বলে উঠি, "গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় । সুরকার মান্না দে ।"
বিধাতা বলেন, "কারেক্ট!"
এর পরের গানটিও পরিচিত :
"মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ করো না
তোমার ও দুটি চরণ বিনে আমার মন
অন্য কিছু আর জানে না....।"
গলার স্বরেই বুঝতে পারি কোনো বয়ষ্ক লোকের গলা । হয়তো পান্নালাল ভট্টাচার্যের মত সাধক ছিলেন । এর পরের গানটির জন্য আমি তৈরি ছিলাম না :
"না হাত মিলানা,না বাহার জানা, ঘারমে হি পাড়ে হ্যায়..........করোনা করোনা ও করো না...।"
এই গানটি অতি সম্প্রতি ইউ-টিউবে লোড হয়েছে । একটি অল্প বয়সী ছেলে গিটার বাজিয়ে গানটি গেয়েছে । করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা ধর্মী গান । এই গানের রেশ নিয়ে কেউ মারা গিয়েছে, আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না । এর পরের গানটি আমায় যথেষ্ট উজ্জীবিত করে :
"চেয়ে দেখ উঠেছে নতুন সূর্য
পথে পথে রাজপথে চেয়ে দেখ
রংয়ের খেলা
ঘরে বসে থেকে লাভ কী বলো
এসো চুল খুলে পথে নামি,
এসো উল্লাস করি
দুঃখিনী দুঃখ করো না....।"
গানটির সুরকার এবং গীতিকার কে জানিনা । বিধাতা নিজের থেকেই বলেন, "বাংলাদেশি ব্যান্ডের গান। কণ্ঠ- জেমস্ । কথা- জেমস্ ও দেহলভী ।"
আমি শুম্ভ-নিশুম্ভকে বলি, " এতজন বাঙালি করোনায় মারা গিয়েছেন, আমি বিশ্বাস করিনা !"
- এই তালিকার সবাই যে বাঙালি, তোমায় কে বলেছে? তোমাদের তালিকার বাইরেও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন । এরমধ্যে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালিও আছেন । তাঁরা বিদেশের স্থায়ী নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন ।
বিধাতা বললেন," তোমাদের স্টকে আর কি আছে?"
মিউজিক সিস্টেমে পূর্ণদাস বাউলের বহুশ্রুত একটি গান বেজে উঠে:
"গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না,
গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না ।
ও আমার পিরিতি কাঁঠালের আঠা,
ও রে পিরিতি কাঁঠালের আঠা
ও আঠা লাগলে পরে ছাড়বে না....।"
গানটি শুনে আমার মনে ভয় ঢুকে যায় । এই গানটি আগে অনেক শুনেছি । অবশ্য যৌবনে । আমার বয়সতো কবেই পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে । করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিচারে আমি ভালনারেবল্ । যতটুকু বেঁচেছি , সন্তুষ্ট । কিছু লেখালেখিও করেছি । এরমধ্যে কিছু ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে । কিছু বদন-কিতাবের পাতায় লুকিয়ে আছে । আমি হঠাৎ সব অপ্রকাশিত লেখালেখিকে একত্রিত করার একটি তাড়না অনুভব করি । আমার মৌতাত টুটে যায়। পরদিন আমি আবার ফেসবুক এক্টিভেট করি । এখনও লেখালেখি একত্রিত করার কাজে হাত লাগাইনি । এই সময়টাকে কাজে লাগাবো ।