বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রনব মুখার্জি
প্রদীপ চক্রবর্তী
প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক সিরিজের তৃতীয় খণ্ড দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস। এরও আগে তিনি লিখেছেন দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস ও দ্য টারবুলেন্ট ইয়ারস। তিনটি বইয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ইন্দিরা গান্ধীর পরিবার এবং ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী ও প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে।
বইয়ের এই অধ্যায়টি প্রণব শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। এরপর জওহর লাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতে যখন এসব ঘটছিল, তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ ঘটনাই ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের জন্য বছরের শুরুটা ইতিবাচক হলেও বছরের শেষে দেশটি ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল দুটি পৃথক ভৌগোলিক অংশের সমন্বয়ে, যার মাঝখানে ছিল ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামে তারা দুটি দেশে পরিণত হয়।’
এরপর প্রণব মুখার্জি পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের শোষণ ও বঞ্চনা তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশে যে ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, তারও নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দেন। তাঁর লেখায় আছে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে কী প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। ৩০ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের লোকসভায় নেওয়া প্রস্তাবটি ছিল এ রকম: ‘পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে লোকসভা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেখানে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ন্যায়সংগতভাবে যে রায় দিয়েছে, সেই রায়ের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানোর বদলে পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছে। এই লোকসভা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি
সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করছে এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিলম্বে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।’
প্রণব মুখার্জি তখনো ইন্দিরার দলে ভেড়েননি। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রণব লিখেছেন, ‘১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রণব কী ভূমিকা রেখেছেন, তা–ও তিনি আমাদের জানিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তিনি লিখেছেন, ‘সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তসংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন। সেই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তাঁরা যে যাঁর দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।’ প্রণব মুখার্জি ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ সালে ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য হন।
সাংবাদিকদের মতে বাংলাদেশের প্রতি প্রণব মুখার্জির দুর্বলতা অপরিসীম; অনেকটা জ্যোতি বসুর মতোই। জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি ছিল বারদিতে, লোকনাথ বাবার আশ্রমের পাশেই। সেই অর্থে তিনি ছিলেন বাঙালী।
প্রণববাবু আপাদমস্তক ঘটি তাঁদের আদি বাড়ি দীঘাতে। তবে বিবাহসূত্রে তিনিও বাংলাদেশের জামাই।
সিপিআইএমের নেতা জ্যোতি বসু একাত্তরের জুলাই মাসে বিধানসভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছে এবং সেখানকার মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছে। আমাদের উচিত সর্বতোভাবে তাদের সহায়তা করা।’
ভারত-পাকিস্তান বিবাদের কারণে সার্ক এখন পুরোপুরি অকার্যকর। কিন্তু ২০০৬ সালে প্রণব মুখার্জি , পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে সার্ককে কার্যকর সংস্থা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ২০০৭ সালের এপ্রিলে যখন দিল্লিতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হয়, সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকার কথাও সবার জানা। ওই সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আন্ত-আঞ্চলিক সংযোগ ও জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। আর যখন অকংগ্রেসি সরকার আসে, তখন সম্পর্ক ভালো হয়। প্রণব মুখার্জি এই ধারণা অনেকটা অসত্য প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তরণ ঘটে।
বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির একধরনের হার্দিক সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা হলো: ‘ভারত ও বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী নয়; তাদের মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত বন্ধন। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভারত সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কেননা, আমরা অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক সংহতি ধারণ করি।’
২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়। এতে অনেক ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। সেই ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, দুর্যোগের খবর পেয়েই ভারত ওষুধ, তৈরি খাবার, কম্বল, তাঁবু ও বহনযোগ্য বিশুদ্ধ পানিসহ ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশে পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত চাল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। প্রণব মুখার্জির উদ্যোগেই বাগেরহাটের দুটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ২ হাজার ৮০০ ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয় পঁচাত্তরের পর তিনি (শেখ হাসিনা) যখন দিল্লিতে নির্বাসিত ছিলেন। সেই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।’ সে সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘প্রকৃত ঘটনা হলো, যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাঁকে ত্যাগ করছিলেন, আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক।’