।। মেঘমল্লার ।।
অরিন্দম নাথ
ভাদ্র মাসের এগারো তারিখ । শুক্রবার ৷ স্থান, আগরতলা শহরতলির একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র । সারাদিন ভ্যাপসা গরম গিয়েছে । একটু বৃষ্টি হলে ভালো হয় । বিকেল থেকে আকাশে মেঘের এদিক সেদিক আনাগোনা । ঘরের ভিতরও এক মেঘ । ইন্টার্নি ডাক্তার । হবু ডাক্তারেরা দুটি শিফটে ডিউটি করে । সকাল দশটা থেকে চারটা । চারটা থেকে রাত্রি দশটা । সঙ্গে একজন পূর্ণ ডাক্তার থাকেন । এই বেলায় মল্লার ডাক্তারবাবু ডিউটিতে । অবিবাহিত । সাতাশ বছরের যুবক । সরকারি কলেজের স্নাতক । মেঘ বেসরকারি কলেজে পড়াশুনা করেছে । মেঘের এখানে তিনমাস পূর্ণ হতে চলেছে । সাধারণত একমাস এইসব পি এইচ সি-তে প্রশিক্ষণ চলে ৷ তারপর বড় কোন হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে ডিউটি করতে হয় । এখন করোনা কাল ৷ রোটেশন বন্ধ । মেঘ এখানেই ট্রেনিং নিচ্ছে । বিধাতাও মনে হয় এই চেয়েছিলেন । তিনমাসে দুইটি নবীন প্রাণ অনেক কাছাকাছি এসেছে । পারস্পরিক পছন্দ অপছন্দের কথা বলে । কলেজ জীবনের গল্প করে । এমনিতে গভর্নমেন্ট কলেজ এবং প্রাইভেট কলেজের স্নাতকদের মধ্যে রেষারেষি থাকে । মেঘ ও মল্লারের মধ্যে এই জিনিসটা নেই । একে অপরের কলেজের ভালো দিকগুলোর কথা বলে । মল্লারের ধারণা মেঘদের কলেজের ইনডোর ফ্যাকাল্টি ভালো । মেঘের আপসোস মল্লারদের মত যদি প্র্যাক্টিক্যাল করার সুযোগ পেত । আজ সন্ধ্যার পর থেকে একজনও রোগী আসেনি । দুজনে বসে গল্প করছিল । মেঘের বাবা স্কুল শিক্ষক । তাদের গাড়ি আছে । মারুতি অল্টো । বাবা নিজেই ড্রাইভ করেন । দশটার দিকে এসে নিয়ে যাবেন। আজ ছোটবোন বৃষ্টিও সাথে আসবে । সে এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাশ করেছে । ভালো রেজাল্ট করেছে । তার ইচ্ছে জেনারেল লাইন নিয়ে পড়বে । দিল্লিতে কোনও একটা কলেজে ভর্তি হবে। লেডি শ্রীরাম কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছে । তাদের স্কুলের সিনিয়র অনেকেই সেখানে পড়েছে । তার ইচ্ছেতে পরিবারের সবাই মত দিয়েছে । বোন খুব শীঘ্র চলে যাবে । মেঘ বৃষ্টিকে নিজের অনুরাগের কথা বলেছে । বৃষ্টি তাই মল্লারকে দেখতে আসছে । বাবা-মা এই খবর জানেন না। ওদের আর কোনও ভাইবোন নেই ।
এখন রাত্রি সাড়ে সাতটা । আকাশের গুমোট ভাবটা আরেকটু বেড়েছে । মেঘের কভার বেড়েছে । মেঘ মল্লারকে এখনও স্যার বলে ডাকে । ওরা যখন একান্তে থাকে মেঘ ভীষণ হেসে কথা বলে । অন্য সময় তাকে গম্ভীর দেখায় । এখন হঠাৎ একটি মজার কথা তার মনে এসেছে । সে নিজের মনে হাসছে । 'তুমি হাসছ কেন ?', মল্লার প্রশ্ন করে ।
- আমাদের পাড়াতে না 'মেঘমল্লার' নামে দুটো বাড়ি দেখেছি ।
- 'মেঘমল্লার' হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের একটি রাগ । বাড়ির যিনি মালিক, তাঁর সঙ্গীতের প্রতি উৎসাহ থাকবে ।
- তা জানি না । একটি-তো মনে হল ডাক্তারের বাড়ি । ওনার বয়স হয়েছে । গান-বাজনার আওয়াজ কখনও শুনিনি । অন্যটি আমাদের বাড়ির খুব কাছেই । এক জেঠু আর জেঠিমা থাকেন । ওনারাও গান-বাজনা করেন না । এক দিদি ছিল । বিয়ে হয়ে গিয়েছে । সে গান শিখত ।
- গান-বাজনার সঙ্গে আরও কিছু সম্পর্ক থাকবে । জেঠু হয়তো তবলা বাজাতেন ।
- হ্যা , হ্যা , ঠিক কথা । পাড়ার একটি অনুষ্ঠানে তবলা বাজাতে দেখেছি । জেঠিমা মনে হয় নাচতেন । এখনও সুন্দর ফিগার মেনটেন করে রেখেছেন ।
- হতেই হবে । নাচ ছেড়ে দিলে মেয়েরা কিন্তু মোটা হয়ে যায় ।
- আমরা বাপু নাচ-গান কিছুতেই ছিলাম না ।
- আমার মা-বাবা দু'জনেই সঙ্গীত অন্ত-প্রাণ । পরিবারের সবার নাম সঙ্গীতের রাগের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা । তৃতীয় জেনারেশন চলছে ৷ ঠাকুরদার নাম ছিল ভৈরব ৷ ঠাকুরমার ললিতা ৷ বাবার নাম দীপক । মায়ের নাম জয়ন্তী । দিদির নাম সাহানা । রবিঠাকুরের একটি গান আছে, ‘চাঁদের হাঁসির বাঁধ ভেঙেছে’—। গানটির প্রথম অংশ সাহানা রাগে গাওয়া হয় । শেষের অংশে নাকি মল্লারের মিশ্রণ ঘটেছে । তাই আমাদের ভাইবোনের নাম সাহানা আর মল্লার ।
- সুপার! সুপার!
- তোমার নামটিও কিন্তু একটি রাগ ।
- তাই! আপনি সঙ্গীতের এতকিছু জানেন ।
- আমার বাবা বাংলার অধ্যাপক হলেও সঙ্গীতের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত । মা শিক্ষিকা । আকাশবাণী ও দূরদর্শনের শিল্পী ছিলেন । দিদিতো গানের স্কুল চালায় । আমিও একসময় গান শিখতাম ।
- বুঝতেই পারছি ৷ একদিন আপনার গান শুনব । আপনার সঙ্গে কথা বলে ভীষণ ভালো লাগছে । সঙ্গীতের এত গভীরতা আমার জানাই ছিল না ।
বলতে বলতে বেশ জোরদার বৃষ্টি নামে । মল্লার তার কথা চালিয়ে যায়, "সঙ্গীতের উৎপত্তি হয়েছে ভারতবর্ষে । দেবতারা নাকি সঙ্গীতের স্রষ্টা । প্রথম সুর তৈরি হয়েছিল পাখির স্বর নকল করে । প্রথমে ছিল সাতটি স্বর । সাতটি জীবের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে । ময়ুর থেকে ‘সা’ । বৃষ থেকে ‘রে’ । ছাগল থেকে ‘গা’ । বক থেকে ‘মা’ । কোকিল থেকে ‘পা’ । ঘোড়ার থেকে ‘ধা’ । হাতির থেকে ‘নি’ । তারপর পাঁচটি উপ-স্বর যোগ হয় । এই বারটি স্বরের মিশ্রণে সৃষ্টি হয় রাগ । মনোরঞ্জন করা থেকে রাগ । মোট ছয়টি রাগ । মহাদেবের মুখ থেকে পাঁচটির সৃষ্টি । শ্রী, বসন্ত, ভৈরব, পঞ্চম আর মেঘ । পার্বতীর মুখ থেকে একটি । নট-নারায়ণ ।
- তাহলে আমার নামের উৎপত্তি সৃষ্টির প্রথম দিকে ! আর আপনার নাম ?
- আমার নামের সৃষ্টি মেঘ রাগ থেকে । এই ছয়টি রাগের প্রতিটি থেকে সৃষ্টি হয় ছয়টি করে রাগিনী । পরে রাগ-রাগিনী মিশে একাকার হয়ে যায় । সবগুলোকেই রাগ বলা হয় ।
- তাই, মেঘমল্লার ?
- ঠিক তাই ! ছয়টি ঋতুর সঙ্গে মিল রেখে ছয়টি রাগ রয়েছে । গ্রীষ্মের রাগ দীপক । বর্ষার রাগ মেঘ । শরতের রাগ ভৈরব । হেমন্তের রাগ মালকোষ । শীতের রাগ শ্রী । বসন্তের রাগ হিন্দোল ।
- সবমিলিয়ে কয়টি রাগ ?
- বারটি স্বর উপ-স্বর থেকে মোট ৭২ টি রাগ । তারপর প্রতিটি রাগকে ৪৮৩ টি উপরাগে ভেঙ্গে ফেলা হয় । ফলে মোট ৪৮৩ x ৭২ = ৩৪৭৭৬ রকমের সঙ্গীত তৈরি হয় । এভাবেই জন্ম হয় ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের । আধুনিক যেকোনও বাদ্য যন্ত্রের বাজানাই এই ৩৪৭৭৬ বিন্যাসের মধ্যে থাকবে ।
- মেঘমল্লার রাগের বৈশিষ্ট্য কি ?
- এই প্রশ্নের উত্তর আমি সঠিক দিতে পারবো না । কারণ, মেঘমল্লারের কয়েকটি ভ্যা রাইটি আছে । মল্লারি, মল্লারিকা, মলহর, মলহার ইত্যাদি । স্থূলভাবে বলতে গেলে 'সারেগামাপাধানি' থেকে 'গা' আর 'ধা' বাদ দেওয়া হয় । ছাগল আর ঘোড়ার স্বর । এই প্রাণী-দুটো হয়তো বৃষ্টিকে ভয় পায় ৷ মেঘমল্লার গাইলে বৃষ্টি নামে ৷ ‘সা রে মা পা ণি র্সা / র্সা ণি পা মা রে সা’ এই পারমুটেশন কম্বিনেশনে আরোহ এবং অবরোহ ঠিক করা হয় । ঠিক যেন পাহাড়ে ওঠানামা ৷ লক্ষ্য করে দেখ, বৃষ্টির তেজ যেন সঙ্গীতের মতই ওঠানামা করছে ।
ওরা দু’জন চুপচাপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে থাকে ৷ হাসপাতালের টিনের চালে বৃষ্টির ফোটা অদ্ভুত সিম্ফনির সৃষ্টি করে ৷
মেঘ নীরবতা ভঙ্গ করে, ‘বৃষ্টির তোড় হঠাৎ যেমন বেড়ে যায় ৷ ঠিক সেই লয়েই যেন কমতে থাকে ৷ যেন প্যালিনড্রোমিক মোশন!
- হ্যা, বলতে পার ৷ মেঘমল্লার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মিঞা-কি-মল্হার না বললে অসম্পূর্ণ থাকবে ৷ এই রাগের স্রষ্টা তানসেন ৷ মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে তানসেন, বৈজু বাওরা, বাবা রামদাস প্রভৃতি ছত্রিশ-জন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ৷ তানসেন ছিলেন মুখ্য ৷ তিনি মিঞা-কি-মল্লার, দরবারী কানাড়া, মিঞা-কি-সারং, মিঞা-কি-তোড়ী, দীপক প্রভৃতি রাগের রচয়িতা ৷ দীপক রাগ ছিল ভীষণ কঠোর প্রকৃতির ৷ বলা হয় যে এই রাগ গাইলে গান থেকে আগুন সৃষ্টি হত ৷
- তাই!
- একবার আকবর বাদশাহ রাগ-দীপক শুনতে চান ৷ তানসেন রাজি ছিলেন না ৷ তাঁর কথায় বিপদ হতে পারে । বাদশাহ সেই কথা শুনলেন না ৷ আকবরের নির্দেশে তানসেন রাগ শুরু করলেন । ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে লাগল । তারপর আশ্চর্য ঘটনা ঘটল । সভার সমস্ত প্রদীপ জ্বলতে শুরু করল । তানসেন সভার বইরে চলে গেলেন ৷ নদীর ধারে গিয়ে বসে গাইতে লাগলেন । নদীর জল ফুটতে শুরু করল । বাদশাহ প্রমাদ গুনলেন । তানসেন বিভোর হয়ে গাইছেন ৷ তাঁকে থামানো সম্ভব নয় । শিল্পী মারা যাবেন ৷ এই অবস্থায় গুজরাটের ভাদনগরে দুই যমজ বোনের খোঁজ পড়ল ৷ তারা ও রিরি । তাঁরা রাগ-মল্লার গাইতে পারত ৷ সম্রাট আকবরের নির্দেশে দুই বোন গাইলেন ৷ রাগ-মল্লার । মুষলধারে বৃষ্টি নামল । আগুন নিভল ৷ সব কিছু রক্ষা পেল।
- এখন কেন আমরা এমন সঙ্গীতজ্ঞ পাই না ?
- বলা মুশকিল ৷ এখন নিশ্চয় আমাদের শিল্পীরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ফোকাস হারিয়ে ফেলেছেন ৷ শব্দ একটি শক্তি ৷ আর শক্তির বিনাশ নেই ৷ রূপান্তর সম্ভব ৷ শব্দ শক্তি থেকে তাপ শক্তিতে রূপান্তর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সম্ভব ৷ প্রসঙ্গত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মেঘমল্লার" নামে একটি গল্প আছে ৷ তার কথায় মেঘমল্লার রাগ শুনে দেবী সরস্বতী মর্তে আবির্ভূতা হতেন ।
বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে ৷ তাদের দুজনের খেয়াল ছিল না ৷ মেঘের সম্বিৎ ফিরে বৃষ্টির গলা শুনে, “দিদি!” মেঘ বাবা ও বোনের সঙ্গে মল্লারের পরিচয় করিয়ে দেয় ৷ বড় মেয়ের দীপ্ত-রাগ পিতার নজর এড়ায় না ৷ বুঝিবা তিনি উপভোগ করেন ।