।। পথ চলিতে ।।
অরিন্দম নাথ
(১)
অনেকদিন পর চিত্রলেখার কথা সুজয়ের মনে এলো । আজ কম করে পঁচিশ বছর । এরমধ্যে চিত্রলেখার কথা যে তার মনে আসেনি এমনটা নয় । ছাত্র জীবনের পর থেকে সে নিজের শহর ছেড়েছে । আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড । রাজ্যের বাইরে ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে । সে নিজেও এখন সংসারী । মেয়ে সেঁউতি কলেজে পড়ছে । স্যোশাল মিডিয়াতেও যোগাযোগ নেই । আজ হঠাৎই সুজয় চিত্রলেখার বর্তমান অবস্থা জানার তাড়না অনুভব করলো । ঘণ্টা দেড়েক কসরতের পর ফেইসবুকে চিত্রলেখাকে খুঁজেও পেল ।
(২)
সুজয় একটি সরকারি দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরী করে । এখন করোনার আবহে অফিসে কাজের চাপ কম । অফিসে অবসর সময় কাটে দৈনিক পত্রিকার ইন্টারনেট এডিশনগুলি পড়ে । এর বাইরেও স্যোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের খবরের আপডেট আসে । আগস্টের সতের তারিখ এমনি একটি খবর ভেসে আসে। শাস্ত্রীয় সংগীতের দুনিয়ায় নক্ষত্রপতন । আমেরিকায় প্রয়াত হয়েছেন পণ্ডিত যশরাজ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল নব্বই বছর । অনেক দিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন । শাস্ত্রীয় সংগীতের জন্যে ভারতে পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রীর মতো একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি । রয়েছে বহু বিদেশি পুরস্কার এবং সম্মানও । গত বছর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পণ্ডিত যশরাজের নামে একটি ছোট গ্রহের নামকরণ করেছে । ভারতীয় সংগীতের প্রথম শিল্পী হিসেবে পণ্ডিত যশরাজ এই দুর্লভ সম্মান পান । গ্রহটির নাম দেওয়া হয় 'পণ্ডিত যশরাজ (৩০০১২৮)'। তাঁর জন্ম তারিখের উল্টো-ক্রমে । মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝে একটি গ্রহাণুপুঞ্জে ছোট্ট এই গ্রহটির অবস্থান । চিত্রলেখাও একটি নক্ষত্রের নাম । হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র । ঊষা এবং অনিরুদ্ধ নামক তারার সঙ্গে মিলিত হয়ে চিত্রলেখা কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলের কোমরবন্ধের সৃষ্টি করেছে ।
(৩)
ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী পণ্ডিত যশরাজের গানের সঙ্গে সুজয়ের পরিচয় চিত্রলেখাদের বাড়িতে যাবার সুবাদে । চার পাঁচবার গিয়েছে । তখনও সে আগরতলায় পড়তে আসেনি । একটি মফস্বল শহরে থাকে । পাশের শহরে তার মামার বাড়ি । কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার দূরে । বাই-সাইকেলে অনায়াসে পাড়ি দেওয়া যায় । উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছে । ভালো ছাত্র । তখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স ছিল না । পরীক্ষার পর বড় অবকাশ মিলতো । দুটো টিউশনি তাকে পকেট খরচ যোগাত । তাদের পরিবার বেশ বড় । ভাইবোন পাঁচজন । বাবার আয়ের উপরই সংসার চলে । ভদ্রলোক একটি অফিসের হেড-ক্লার্ক ছিলেন । তুলনায় তার মামার বাড়ির অবস্থা ভালো । মামা শিক্ষক । দুই ছেলে চাকুরী করে । ধানের জমিও আছে । বর্গা দিয়েও সারা বছরের খোরাকি থাকে । ছেলে-মেয়ে চারজন । বোন চৈতালি ছোট । ভাইদের মধ্যে পঙ্কজ দ্বিতীয়। সুজয়ের চেয়ে বছর চারেকের বড় । তথাপি দাদা পঙ্কজের সাথেই সুজয়ের ভাব । বিজ্ঞানের স্নাতক হয়েই স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী পেয়ে গিয়েছিল । নিজের শহরেই পোস্টিং । পঙ্কজদার একটি মোপেড ছিল । সপ্তাহান্তে সুজয় চলে যেত মামার বাড়ি । তারপর থেকে দাদার বাইকের পেছনেই হত সুজয়ের অলিখিত ঠিকানা ।
পড়াশুনার পাশাপাশি পঙ্কজ ছিল তবলায় বিশারদ । বলতে গেলে তবলাই তার ধ্যান-জ্ঞান ।রাধাকান্ত নন্দীর ভক্ত । গায়ক মান্না দে এবং তবলচি রাধাকান্ত নন্দীর বুল তখন কথা বলতো । পঙ্কজ সারাক্ষণ, 'ধাˈ ধিনˈ নাˈ, নাˈ থুনˈ না, ধাˈ ধিˈ নাˈ, নাˈ তিˈ নাˈ, ধিন ধিন ধাগে তেরেকেটে, ধাগে তেরেকেটে ধি না, ধাগে তেরেকেটে তুনা কৎতা, ইত্যাদি বুল কাটতো । সাথে টেবিলের উপর তাল ঠুকতো । দাদার সাথে সুজয় চিত্রলেখাদের বাড়িতে যেত । পঙ্কজদা চিত্রলেখা ও তার বোন চিত্ররেখার গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতো ।
(৪)
চিত্রলেখা নামের অর্থ ছবির মত সুন্দর । এক অর্থে সার্থকনামা । শ্যামলা ছিপছিপে গড়ন । নাক-মুখ যেন পাথরে খোঁদাই মূর্তি ভাস্কর্য । তখন সাদাকালো ছবির যুগ । ছবিতে তাকে আরও সুন্দর দেখাতো । এককথায় ফটোজিনিক । সুজয়ের ভালো লাগতো । সুজয়ও দেখতে সুন্দর ছিল । বয়সে কিছুটা বড় । তুলনায় চিত্রলেখার ছোটবোন চিত্ররেখা ছিল ফর্সা । সেও সুন্দরী । তবে নাকটা একটু বেমানান ছিল । কিছুটা ধ্যাবড়ানো । দুই বোনই খুব মিষ্টি স্বভাবের । তাদের বাবা একটি কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে চাকুরী করতেন । মা গৃহিণী । ত্রিপুরায় তাদের আত্মীয়-স্বজন ছিলেন । তাই পরিবার এখানেই থাকতো ।
মাসিমার নাম ইমন । ওনার মুখে জানতে পারে দুই মেয়েরই জন্ম আসামের তেজপুরে । সেখানে চিত্রলেখা বলে একটি পার্ক আছে । পার্কের নাম থেকেই মেয়ের নাম । চিত্রলেখা একটি তারা । জীবনে সে প্রথম জানতে পারে । ওই পার্কের ঐতিহাসিক শৈলস্তম্ভে দশাবতার মূর্তি, উষা-অনিরুদ্ধের প্রেম কাহিনী ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে । সাথে আসামের প্রাচীন সংস্কৃতি । ছোট মেয়ের নাম বড় মেয়ের সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে । উৎস, রবীন্দ্রনাথের একটি গান । 'ওরে চিত্ররেখাডোরে বাঁধিল কে-- বহু- পূর্বস্মৃতিসম হেরি ওকে..।' সংস্কৃতি-মনা এই পরিবারটিকে সুজয়ের ভালো লাগে ।
সুজয় নিজে গান জানে না । কোনও বাদ্যযন্ত্রেও তালিম নেয়নি । চিত্রলেখাদের বাড়িতে গিয়ে সে পাশে একটি চেয়ারে বসে থাকতো । কোনও বই কিংবা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতো । যদিও কান পড়ে থাকতো গানের আসরে । মাঝেমধ্যে মাসিমা এসে দু'য়েক কথা বলতেন । 'তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা, মর্মে আমার আছে সে বারতা--'। সবমিলিয়ে সুজয় একধরনের ইনফ্যাচুয়েশনে ভুগত ।
চিত্রলেখা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি নজরুল সংগীত শিখত । চিত্ররেখাও গান শিখত । সে রবীন্দ্র সংগীত গাইত । ওরা প্রায়ই পণ্ডিত যশরাজের ক্যাসেট বাজাত । সাথে ভীমসেন যোশী, ফৈয়াজ খাঁ, গোলাম আলী, তালাত মামুদ প্রভৃতি গায়কের গানও শুনত । ভীমপলশ্রী, ভৈরব, ভূপালী, বেহাগ, বৃন্দাবনী সারং, দরবারি-কানাড়া ইত্যাদি রাগ নিয়ে আলোচনা করত । ভৈরব সকালের রাগ । ভীমপলশ্রী বিকেলের । স্মৃতি এবং ব্যথা-বেদনা থেকে একেকটি রাগের সৃষ্টি হয় । দরবারি-কানাড়া রাজার চোখের জল । প্রজা-হিতৈষী রাজারা অনেক কষ্টে কাটান। রাজ্যপাট ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান । সন্ন্যাসীর মত ঘুরে বেড়াতে চান । কিন্তু পালাতে পারেন না । দরবারি-কানাড়া শুনে চোখের জল ফেলেন ।
(৫)
চিত্রলেখা প্রায়ই একটি গান গাইত :
"পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণপ্রিয় ।
চাহিতে যেমন আগের দিনে তেমনি মদির চোখে চাহিও ।।"
এই বিষাদ-মাখা সুরের গান শুনতে-শুনতেই একদিন সুজয়ের পরীক্ষার ফল বেরুল । আশানুরূপ না হলেও সে ভালো ফল করল । ছোট্ট শহরের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশুনার জন্য অন্য।ত্র পাড়ি দিল । সেখানে শাস্ত্রীয় সংগীত কিংবা বাংলা গানের চর্চা কম । তুলনায় হিন্দি গানের প্রচলন বেশী । কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের জীবন অন্যর রকম । সেখানে গ্রামীণ স্নিগ্ধতা নেই । খিস্তি দেওয়া, নেশা করা, নিষিদ্ধ-ছবি দেখা একধরনের বাহাদুরি । সারাক্ষণ হৈ-হুল্লোড়ে কাটে। সময় কিভাবে এগিয়ে যায় খেয়ালই থাকে না । সুজয় আর আগের মত ইন্ট্রোভার্ট থাকে না । আবার শৈশব কৈশোরের সংস্কার কোনও সহপাঠিনী কিংবা বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায় না । ততদিনে সে সমাজ জীবনের রাজনীতি ও কূটনীতি একটু একটু করে বুঝতে শিখেছে । তথাপি লেখাপড়া শেষ করার পর চাকুরী পেতে তাকে বেশি অপেক্ষা করতে হয় না । ভালো চাকুরী । সে এক সত্য উপলব্ধি করে । সময় চলমান । প্রতিটি জীব সময়ের দায়রায় আবদ্ধ । সময়ই পথ দেখায় । চলতে শেখায় ।
(৬)
তখনও সায়ন্তনীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি । সে একটি মফস্বল শহরে পোস্টেড । একদিন এক প্রবীণ ব্যক্তি তাকে আগরতলায় ডেকে পাঠালেন । দেখা করার জন্য। তিনি একটি প্রশাসনিক বড় পদে কর্মরত । চিত্রলেখাদের পারিবারিক বন্ধু । সে একটু অবাক হয় । তিনি তার দপ্তরের বস নন । তথাপি ওনার সঙ্গে দেখা করে। প্রথমে কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞাসা করেন । দু'একটি মামুলি প্রশাসনিক কথা হয় । তারপর হঠাৎ চিত্রলেখার বাবার নাম নিয়ে বলেন, ভদ্রলোক এসেছিলেন । মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে গেছেন । চিত্রলেখার বিয়ের তারিখ মাস-খানেক পর । একটু অবাক হলেও সে ভদ্রলোককে প্রণাম জানিয়ে ফিরে আসে ।
ইচ্ছেরা প্রাণ পেলে বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দময় হয়ে ওঠে । সেদিন রাত্রিতে তার স্বপ্নে চিত্রলেখা দেখা দেয় । সে গাইছিল :
"ভীরু এ মনের কলি ফোটালে না কেন ফোটালে না —
জয় করে কেন নিলে না আমারে, কেন তুমি গেলে চলি।।"
পরদিন সে ভাবে, জীবন বাঁচার জন্য । মন হল দেবার জন্য । ভালোবাসা হল সারাজীবন পাশে থাকার জন্য । মন দেওয়া এবং ভালোবাসার মধ্যে সূক্ষ্ম প্রভেদ রয়েছে । মন দেওয়ার সময় আমরা আমাদের পূঁজির কথা চিন্তা করি না । কিন্তু ভালোবাসার জনকে পেতে হলে অনেক হিসেব-নিকেশ করি । তবু ভুল হয়। আমরা অর্ধেক দুঃখ পাই ভুল লোককে বিশ্বাস করে । অর্ধেক দুঃখ পাই সঠিক লোককে ভুল বুঝে । অনেক কিছু হারিয়ে যায় । রিক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত ধার করি। হাউস লোণ, কার লোণ, স্টাডি লোণ, বিজনেস লোণ এমনি অনেক ঋণ করি । যদিও এর ধরনটা ভিন্ন । প্রথমেই আসে পিতামাতার ঋণ । তাঁদের সৎ আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা । সন্তানরা মান, সম্মান, যশ, প্রতিষ্ঠা পেলে ওনারা খুশি হন । দেব ঋণ । প্রকৃতির দান । এই জন্য আমরা দেবতাদের কাছে ঋণী । প্রতিদানে প্রকৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করি । ঋষি ঋণ । সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এই ঋণের উপহার । শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলির কথা তার মনে আসে । চিত্রলেখাদের পরিবারের কাছেও সে এক অর্থে ঋণী । সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে । পারিপার্শ্বিক প্রতিটি মানুষের কাছে আমরা ঋণী । মানুষ বাঁচার জন্য অন্য প্রাণী এবং জীবকে হত্যা করে । অধিকাংশ সময় খাদ্যে-খাদকের সমীকরণে । তাই প্রতিটি প্রাণী এবং জীবের কাছে আমরা ঋণী । কুকুর, বিড়াল, পশু, পাখি, মাছ ইত্যাদি আমরা পুষে ঋণ চুকাবার চেষ্টা করে । 'আপনি যে আছে আপনার কাছে, নিখিল জগতে কী অভাব আছে ।' গুরুদেবের গান থেকে সুজয় সান্ত্বনা নেয় । ক্ষণিকের অশান্ত মনকে শান্ত করে ।
(৭)
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে । এখন তার চুলে পাক ধরেছে । এখনও সে জীবন নিয়ে ভাবে । স্যোসাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয় । সেই বসও জীবিত । অশীতিপর বৃদ্ধ । তিনি তাকে আগের মতই স্নেহ করেন । জীবন তার কাছে একটি জীবন্ত বইয়ের মত । তার বইয়ের কিছু পাতা ছেঁড়া । কিছুটা বাধানো । পণ্ডিত যশরাজের মৃত্যু খবর পেয়ে সেদিন চিত্রলেখার ফেইসবুক পেজটি খুঁজে বের করেছিল । বর্তমান সময়ের ছবি । একমনে খুঁটিয়ে দেখছিল । মনে এসেছিল গানের কয়েকটি পঙক্তি :
"পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণপ্রিয়
পথ চলিতে ।।
তোমার প্রিয় যদি পাশে রয়,
মোর প্রিয় সে, করিও না ভয়,
কহিব তারে আমার প্রিয়ারে আমার অধিক ভালোবাসিও ।"
তার খেয়াল ছিল না কখন সায়ন্তনী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । সম্বিৎ ফিরল তার কথায়, 'চালিয়ে যাও, আমার তরফ থেকে নো প্রবলেম!"
সে দ্রুত ফেইসবুক উইন্ডোটি বন্ধ করে দেয় । এরপর আর চিত্রলেখার প্রোফাইল খুলেনি । চিত্রলেখাও নিশ্চয় জানে, সায়ন্তনীকে সে তার চেয়ে বেশী ভালোবাসে ।