!! কোক্কুরুৎ !!

অরিন্দম নাথ

গত শনিবার ছিল স্বাধীনতা দিবস । প্রতিবারের মত সাতটায় অফিসে পতাকা উত্তোলন হবে । তারপর সবাই যাবে আগরতলা আসাম রাইফেলস ময়দানে । সেখানে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান । এবার খানিকটা ভিন্ন রকমের । কারণ করোনা । অতিমারির কারণে অনুষ্ঠানের অনেক কিছু কাটছাঁট হয়েছে । মার্চপাস্ট হবে না । ফৌজের লোকেরা দাঁড়িয়ে সেলামি দেবে । তারপর প্রধান অতিথি ভাষণ দেবেন । শেষে অনলাইনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । অন্য বারের তুলনায় লো-প্রোফাইল । মেঘনাদবাবু প্রতিদিনের রুটিন বজায় রাখার চেষ্টা করেন । পাঁচটায় মর্নিং ওয়াকে বেড়িয়ে যান । বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি বাজার । বড় রাস্তার সঙ্গে গলি রাস্তা যেখানে মিলেছে যেখানটায় । এই ভোর বেলাতেই জনজাতির লোকেরা পসরা নিয়ে বসেছে । দুটো বলেরো পিক-আপ ভ্যান দাঁড়িয়েছিল । অম্পি-তৈদু এলাকা থেকে লোকগুলো আগরতলায় আসে । অধিকাংশ মহিলা । ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা । ওরা ভোর কয়টায় গাড়িতে চেপেছিল, তিনি মনে মনে তাই ভাবছিলেন । তাঁর ভাবনায় ছেদ পড়ে । কোক্কুরুৎ ! কক কক ককার কক…। মোরগের ডাক । এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখেন । কোথাও মোরগ দেখতে পান না । মুহূর্তে আবার 'কক কক ককার কক'…। তাঁকে এভাবে অবাক হতে দেখে মহিলা দোকানিরা হাসে । এবার তিনি দেখতে পান । একটি গাড়ির গায়ে হুক থেকে ঝুলানো একটি খাঁচা । সেই খাঁচার ভেতর মোরগটি । কাপড় দিয়ে ঢাকা । মোরগ বহুগামী । হয়তো তার সাথে বিবিদের মধ্যে কেউ থাকবে । এইমাত্র ক্লোয়াকাল চুম্বন সেরেছে ।

একটি সাম্প্রতিক খবর মনে আসে । ফ্রান্সের ওলেরন দ্বীপের ঘটনা । আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে স্থানটি । সেখানে এক অবসরপ্রাপ্ত দম্পতির ফার্ম-হাউস আছে । তাঁরা নিয়মিত ছুটি কাটাতে যান । তাঁদের প্রতিবেশী করিন ফেস্যোঁ । পেশায় চাষী । করিনের একটি মোরগ আছে । মরিস । মোরগের ডাক সেই দম্পতির পছন্দ নয় । করিনও মরিসের বাক স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মরিসের সমর্থনে অনেক লোক এগিয়ে আসে । তাদের এক কথা । গ্রামে শহরের মানুষ আসবে । তাদের ইচ্ছে নিরিবিলিতে সময় কাটানো । আবার গ্রামের কিছু বাস্তবতা থাকে । পশুপাখি ডাক । পোকামাকড়ের ঘুরে বেড়ানো । এগুলো স্বাভাবিক ছন্দ । এই নিয়েই গ্রামীণ প্রকৃতি । এসবকে আলাদা করা যায় না । আদালত মরিসের পক্ষে রায় দেয় । তার কোক্কুরুৎ বৈধ বলে গণ্য হয় । বাদীর উপর ক্ষতিপূরণ ধার্য হয় । মামলার খরচ বাবদ এক হাজার ডলারের বেশি চুকিয়ে দিতে হয় ।

এই মরিসকে মেঘনাদবাবু দেখেননি । খাঁচার ভিতরেই আবদ্ধ ছিল । তবু কোক্কুরুৎ, তাঁর মন থেকে যায় না । দুপুরের দিকে তিনি ঘরে ফিরে আসেন । খাওয়া-দাওয়ার পর খাঁচায় আবদ্ধ মোরগটির কথাই ভাবেন । মানুষের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মোরগটির তুলনা করেন । করোনার কারণে মানুষ আজ খাঁচায় বন্দী । মুখে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরে । মুখোশ লাগিয়ে কথা বলা যায় । কিন্তু মন খুলে কি কথা বলা যায় ? মেলামেশার সুযোগ কম । ভার্চুয়াল সম্পর্কের বাড়াবাড়ি । তাঁর মনে হয় মোরগের বাক স্বাধীনতা মানুষের চেয়ে বেশি ।

কোক্কুরুৎ, অনেকটা 'কক কক ককার কক'-এর মত শুনায় । অনেকগুলো 'ক'-এর মধ্যে একটি 'র' । প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন একটি কবিতা পড়তে তিনি ভুলেন না । কবি শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' । কবির সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল ৷ আগরতলায় ৷ এবারও পড়লেন । এখানেও 'ক'-এর আধিক্য । 'র'-ও আছে । কবিতার কয়েকটি পঙক্তি তাঁর মনে রেখাপাত করে :

" স্বাধীনতা তুমি

রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান ।

স্বাধীনতা তুমি

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো

মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-

স্বাধীনতা তুমি

রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার ।

স্বাধীনতা তুমি

কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা ।

স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন ।

স্বাধীনতা তুমি

বাগানের ঘর, কোকিলের গান,

বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,

যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা ।"

তিনি এই নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাবেন । তাঁর গ্রামীণ সত্তা নিজের মধ্যে জাগ্রত হয় । নিজেকে মরিস মোরগের মত মনে হয় । কোথাও নিজেকে বিপন্ন মনে হয় । সেকি করোনার আবহের কারণে ? মানুষ আজ উভয়-সঙ্কটে । একদিকে করোনার ভয় ৷ সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব স্বকীয়তায় ফিরে আসতে পারছে না । যারা বাহাদুরি দেখাচ্ছে তাদের পেছন থেকে টেনে ধরা হচ্ছে । রামায়ণে রাবণ মৃত্যুর আগে রামকে কিছু উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন । মোরগকে অনেকে রামপাখি বলে । মোরগ প্রতিদিন ঈশ্বরকে সবার আগে দেখতে পায় । আর তখনই কোক্কুরুৎ রবে সবাইকে জাগিয়ে দেয় । 'কক কক ককার কক'-এর বাইরেও কিছু বর্ণ থাকবে । ইন্তেকাল আসন্ন জেনে মোরগটি হয়তো কিছু উপদেশ দিয়ে গিয়েছে । তিনি 'কক কক ককার কক'-এর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেন ! তাঁর মনে হয়, এর অর্থ, “কহ কথা, কহ করোনার কালে, কসম, রবোনা ক-অক্ষর কূপমন্ডুক হয়ে” ।




You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.