জ্যোতির্ময় রায়: চরম সত্যের মুখোমুখি
সৌম্যদীপ দেব
February 12, 2025
“একটা শুকনো পাতা স্মৃতি বয়েরয়।
বুকের নিচে একটা ছোট্ট নদী আজও তীর তীরিয়ে বয়।”
অন্তরের জলের রেখার দাগ অতীত হয় না কখনো। জীবনের জল শুকিয়ে যায় না। প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয়ে যায় মানুষ। একটু একটু করে রয়ে যায় মানুষ। মানুষ তবুও বাঁচে, জীবন নিয়ে কিংবা জীবনমৃত হয়ে। সুখ খুঁজতে গিয়ে দুঃখ পায়, সুখ পেয়ে আবার দুঃখ থেকে সেরে ওঠে। এভাবেই জীবনের ঘর-গেরস্থালী। জীবনের সঙ্গে বাস করতে হয়। মনকে পড়তে হয়। দরদ দিয়ে পাশে নিয়ে বসতে হয়। তবেই না আত্মদর্শনের আয়নায় নিজের সঙ্গে বলাকওয়ার সুযোগ হয়। জীবনের আঁতুড়ঘরে লোষ্ট্রপাতের শব্দ গোনা সহজ নয়!
দৃশ্য-শ্রাব্য বিনোদন বিস্ফোরণের যুগে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিকে নিয়ে চর্চা কতটা হচ্ছে এটা একটা বড়ো জিজ্ঞাস্য। কাকে নিয়ে করা যাবে? কাকে নিয়ে করা উচিত? আসলে এক ব্যক্তি যখন বহু ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন, ব্যক্তি যখন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন তখন তিনি অনেকের আশ্রয়ে পরিণত হয়। ত্রিপুরার বাংলা কবিতার ধারায় উল্লেখযোগ্য কবি ও সাহিত্য সংগঠক জ্যোতির্ময় রায় চলে গেলেন প্রান্তহীন নিরুদ্দেশের পথে। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে এই বিদায় অনেককিছু অসমাপ্ত করে দিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক, সম্পাদক, নাট্যকার জ্যোতির্ময় সদা যেমন স্বভাবে ছিলেন নম্র, তেমনি সদালাপী ও আন্তরিক। এই জীবদ্দশায় প্রচুর কবিতা লিখেছেন। সৃষ্টি ও সমকালের কথাকাগজ ‘প্রজন্ম চত্বর’ দীর্ঘদিন গৌরবের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন, যা বাংলা কবিতার ঈর্ষণীয় সম্পদ। এই পত্রিকা বাণিজ্যিক ছিল না, বিজ্ঞাপনের বহরও ছিল না। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করেই সম্পাদক তাকে একটু একটু করে আয়ু দান করতেন প্রতিবছর। মূলধন এনে দিতে সমর্থ না হলেও, ‘প্রজন্ম চত্বর’ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বহু অঞ্চলের লেখকের সযত্ন উপস্থিতি আমরা লক্ষ করেছি এই লিটল ম্যাগাজিনে৷ সংসার সাহসী ও জীবন উপভোগী একজন মানুষ ছিলেন কবি জ্যোতির্ময়। বলতেন নানান অভিজ্ঞতার কথা। বহুবার তাঁর সান্নিধ্য ঘটেছে। বলতেন, সৌম্যদীপ জীবনটাকে হাতের তালুর মতো করে যদি না চেনো; জীবন মানুষকে নিয়ে উলটো খেলতে শুরু করে। তুমি খেলার আগে তোমাকে নিয়ে খেলা শুরু করে দেবে। জীবন, সময়, সমাজ বিষয়ে বিপুল অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। অকুতোভয় সাংবাদিকতা করেছেন আজীবন। তাঁর লেখায় বারংবার উঠে এসেছে সরল-শাশ্বত জীবনের উর্বর বলিরেখা। ‘সমর্পিত আত্মার বেদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন — “তোমার প্রথম প্রভাত /আমি দেখিনি/ তোমার চোখের প্রচ্ছদে/ কলঙ্কের ছোপ দেখেছি।/ গুঞ্জন নিয়ে চাঁদ হাঁটে / জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা বিলিয়ে / তুমি বাঁচো নগ্নজলে / দু'হাত তুলে / আমি বয়ে চলি / সমর্পিত আত্মার বেদ।”
সংবাদে যা উঠে আসে না, যা বলা যায় না; সেখান থেকেই গল্পের শুরু। গল্পের বীজ কখন, কোথায় জুড়ে থাকে, ভরে থাকে তা বলা সহজ নয়। সাংবাদিকতা জীবনের নানান অভিজ্ঞতা শোনাতেন। ভাষা আন্দোলন তাঁর জীবনের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি কিংবা বরাকের ভাষা আন্দোলন সব-ই তাঁর লেখনীতে প্রাণবন্ত মাত্রা লাভ করেছে। সালটা ২০২৩ ধলাই সাহিত্য উৎসব। কবি জ্যোতির্ময় অন্যান্যদের সঙ্গে এই উৎসবের উদ্বোধক আর আমি একটি সেশনের আমন্ত্রিত বক্তা। তাঁর সুললিত বক্ত্যবে মুগ্ধ হয়েছিল সভাগৃহ। বক্তব্যের বড়ো অংশ জুড়ে চমৎকারভাবে সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি আর ভাষা আন্দোলনকে সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ করেছিলেন। আসলে কেনো এই ভাষাগত সংকট ও পরিণামে ভাষা আন্দোলন। মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা ও যাপনের ভাষা এই সময়ে কোথায় গিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে তা তিনি যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন বলেই তাঁর বক্তব্যে সারকথা এতটা স্পষ্ট। ফেরার পথে একই ট্রেনে ফেরা। ট্রেনে দেদার সাহিত্য আড্ডা। রয়েছেন আগরতলা থেকে আসা অন্যরাও। খুব স্নেহ করতেন। ভীষণ পছন্দ করতেন। হাতটি ধরে বললেন, “বাবাজী তোমার কলমটি বড্ড ধার।” এমনই লেখো, পাঠকের কাছাকাছি, মাটির কাছাকাছি। প্রকৃতই লেখক, সাংবাদিক জ্যোতির্ময় রায়ের মূল্যায়ন হয়নি। কবি জ্যোতির্ময়, সম্পাদক ও নাট্যকার সবকিছুর জন্যই একদিন হয়তো আরো চর্চিত হবেন; এই প্রত্যাশা অমূলক নয়।
আরও পড়ুন...