'রবি' পত্রিকার আড়ালে
সৌম্যদীপ দেব
পৌরাণিক রাজাগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ঐতিহাসিক রাজারা রাজধানী পরিবর্তন করেছেন। দান পত্র, তাম্র পত্রে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত হরফে লেখা ও উচ্চারণ করা হতো। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসার কালে স্বর্ণমুদ্রা ছাপিয়েছিলেন রাজা শ্রী কল্যাণ মানিক্য। টাকার গায়ে 'শ্রী সত্য ' লেখা থাকতো। কর্ণেল মহিম ঠাকুর রাজাদের কর্ণেল ছিলেন। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্ক রক্ষা করার বিশেষ দায়িত্ব পালন করতেন মিহিম ঠাকুর। তখন এক সভায় মহিম ঠাকুর, ঈশ্বর গুপ্ত উপস্থিত ছিলেন। তখন মহিম ঠাকুরের গলার লকেটে বাংলা হরফ দেখে ঈশ্বর গুপ্ত বলে উঠলেন -
"আমার বাংলা রাজ ভাষা। "
১৩২৪ বঙ্গাব্দে 'কিশোর সাহিত্য সমাজ ' ত্রিপুরার সাহিত্য চর্চায় আগ্রহীদের জন্য একটা সাহিত্য পত্রিকার দাবি করে। তখন রাজবাড়ির আনুকূল্যে ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নানা গুণী লেখকের ইচ্ছায় 'কিশোর সাহিত্য সমাজ' আরোও সমৃদ্ধ হলো। তখনই সাহিত্য প্রকাশের মুখ হিসাবে পত্রিকা প্রকাশের কথা এলো। পত্রিকার জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হল যথাক্রমে সাহিত্যিক ও লেখক নরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা এবং কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্ত।
'রবি' -র প্রচ্ছদ করে দিলেন চিত্রকার ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ দেববর্মা। সত্যরঞ্জন বসু পত্রিকার শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা থেকে প্রেরিত শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদ্যালয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবা মোক্ষদা কুমার বসু ত্রিপুরার শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্যতম নাম তথা রাজবাড়ির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ভাই বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, তিনি বিলেতে যাবার সময় অর্থাভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুর দরবারে চিঠি দিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে ত্রিপুরার শিক্ষা দান কাজে নিয়োজিত করেন।
সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করা হলো ত্রিপুরার সাহিত্য পত্রের নাম হবে 'রবি'। ১৯২৪ সালে (১৩৩৪ ত্রিপুরাব্দ) আষাঢ় মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। সিদ্ধান্ত হলো বছরে তিনবার অর্থাৎ 'রবি' হবে ত্রৈমাসিক। রাজ কোষাগার থেকে পত্রিকার জন্য একশো টাকা বরাদ্ধ করা হলো। আর বাকি খরচ বহন করবে লেখক- সাহিত্যিক বৃন্দ। তখন এক শক্তপোক্ত লেখক গোষ্ঠী গড়ে উঠল 'রবি' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন - সত্যরঞ্জন বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশ চন্দ্র সেন, শীতল চন্দ্র মজুমদার, অনঙ্গমোহিনী দেবী, বিদ্যা বসু প্রমুখ।
'রবি' পত্রিকার প্রসার ক্রমেই বঙ্গ জনের কাছে সমাদ্রিত হতে লাগলো। সেই কঠিনতম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে 'রবি' ত্রিপুরা তথা বৃহৎ বঙ্গের বাংলা সাহিত্যচর্চায় এক স্বর্ণযুগের আবহ সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ই ফাল্গুন লালু কর্তার ডাকে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় এলেন। ত্রিপুরাবাসী তাঁদের প্রাণের কবিকে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে সম্বর্ধনা দিলেন। তখন ত্রিপুরার এই গৌরবময় দিনে রবীন্দ্রনাথ রাজ্যবাসীকে আহ্বান জানালেন -
" 'রবি' পত্রিকাকে রমণীয় করে তুলুন। ত্রিপুরার ভাষা রাজ ভাষা রূপে পরিগণিত হইয়াছে। "
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও 'রবি' পত্রিকার নানা সংখ্যায় কয়েকবার লিখেছেন। এখানে বিশেষ উল্লেখ্য যে 'রক্তকরবী ' নাটকের সাতটি গান এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।
পরপর ছয় বছরে চব্বিশটি সংখ্যা প্রকাশের পর নানা বিদ্রোহের কথা উঠে আসতে লাগলে রাজ কোষাগারের বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহে তপন কুমার ভট্টাচার্য ও অন্য কয়েকজনের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ) পুনরায় প্রকাশিত হয় ' নব পর্যায়ে রবি' পত্রিকা।
তখন এই পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করতে হাত লাগিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অসম্ভব সব গুণী জনেরা। যাঁদের কথা বলতেই হয় সত্যরঞ্জন বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন বসু, রাজ্যেশ্বর মিত্র, সুকুমার সেন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অন্নদাশঙ্কর রায়, সলিল কৃষ্ণ দেববর্মণ, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ তাবৎ জনেরা। একটি পত্রিকার মধ্যে দিয়ে রাজ আমলের সাহিত্য চর্চার সুনিবিড় ইতিহাস 'রবি'। রবির প্রভার সার্থক উওরসূরী হয়েই ত্রিপুরার সাহিত্য সমগ্র বঙ্গ সাহিত্যে তার আসন লাভ করেছে। সময়ের সাথে যা হয়তো মধ্য গগনে বিরাজিত হবে।