তসলিমা নাসরিন'এর ‘চুম্বন’ অশান্তি এবং বাংলাদেশ !
শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ
February 11, 2025
তসলিমা নাসরিন'এর ‘চুম্বন’ বইটি নিয়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঢাকা, বাংলাদেশ ! ঢাকা পুস্তক মেলায় বইটি বের করার অপরাধে প্রকাশনা সংস্থার ওপর মৌলবাদীরা হামলা চালিয়েছে। সমাজ মাধ্যমে দেখলাম নিন্দার পরিবর্তে সে দেশের কিছু কবি সাহিত্যিক আবার মৌলবাদীদের এই আক্রমণের ঘটনাকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন । এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন হাসিনার সমর্থক বলে কথিত বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত এবং বাংলাদেশের এডিটর্স গিল্ড-এর সভাপতি মোজাম্মেল বাবু সহ ঢাকার অন্তত ১৫০ সাংবাদিক। বাংলাদেশি ইউটিউবে দেখলাম অনেক সাংবাদিকই এই গ্রেপ্তারের সমর্থনে কথা বলছেন! আটক হয়েছিলেন অভিনেত্রী নিপুণ, পরীমনি, শাওন এবং সাবা। এই আটক এবং হেনস্থার বিরুদ্ধেও তাদের নিজেদের ফ্রেটারনিটি থেকে কেউ উচ্চবাচ্য করেন নি।
বাংলাদেশের এই ব্যাপারটাই আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। এমন সব ঘটনার প্রেক্ষিতে এটাই প্রমাণিত হয় মতাদর্শগত ভিন্নতার পাশাপাশি সে দেশে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে প্রফেশন্যাল ফ্রেটারনিটি বা সলিডারটি বলতে কিছুই নেই। ওরা স্পষ্টতই আড়াআড়ি দুই শিবিরে বিভক্ত এবং একে অপরকে নিকেশের তত্বে বিশ্বাসী। আমাদের দেশেও কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে মতাদর্শগত বিভাজন ।
ভারতে কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি বা মৌলবাদীরা তাদের আদর্শের বিরোধী কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা করলে সবাই কিন্তু তখন ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একযোগে তার নিন্দা করেন। এটাই হচ্ছে ভ্রাতৃত্ববোধ বা সংহতি। এর সুস্পষ্ট অভাব রয়েছে বাংলাদেশে। সত্তর দশকে ভারতবাসী ফ্যাসীবাদের চূড়ান্ত রূপ দেখেছিল যখন ইন্দিরা গান্ধী সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন। বিনা বিচারে ধর পাকড় শুরু হয়েছিল। গুম করা হয়েছিল বিরোধীদের। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং কবিতা। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে শোনানো বন্ধ হয়েছিল কিশোর কুমারের গান। বিনা বিচারে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত সহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবী। সেই অরাজকতাকে দলমত নির্বিশেষে নিন্দা করেছিল সবাই। অতঃপর ভারতবাসী ব্যালটের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর সেই স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল। বিবিসি একে আখ্যায়িত করেছিল 'ব্লাডলেস রিভ্যুলিউশন' বলে ।
এরও আগে সত্তর দশকের প্রথমার্ধে পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনকে দমন করার কঠোর নীতি অবলম্বন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। বাংলার বহু বুদ্ধিজীবীই নকশাল আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু নকশাল মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীদের ওপর রাস্ত্রীয় সন্ত্রাসকে কেউ সমর্থন করেন নি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন হাংরি কবি মলয় রায় চৌধুরী। মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্বেও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু সেবার আদালতে মলয় রায় চৌধুরীর সমর্থনে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। আমাদের সময়ে সাহিত্যিক গৌরি লঙ্কেশ'এর হত্যার কথা ভুলেন নি কেউ । সবাই সমস্বরে এই হত্যার প্রতিবাদ করেছে । একই ভাবে সব কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী মকবুল ফিদা হোসেনের ওপর মৌলবাদীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। রিপাবলিক টিভি’র কর্ণধার এবং সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী এ দেশে অনেকেই। ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর'এ মুম্বই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল । প্রচণ্ড মতবিরোধ থাকা সত্বেও বাকি সাংবাদিকেরা কিন্তু এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। অর্ণবের প্রবল সমালোচক সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই পর্যন্ত এই গ্রেপ্তারের নিন্দা করেছিলেন।
এটাই হচ্ছে প্রফেশন্যাল ফ্রেটারনিটি কিম্বা সলিডারিটি। আজ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন দেখি এক দল কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী অপদস্থ হচ্ছেন - আর এক দল তার সমর্থনে রাষ্ট্রশক্তি এবং মৌলবাদীদের বাহবা দিচ্ছেন তখন অদ্ভুত লাগে বই কী ! কোনও দেশ কোনও শাসন ব্যবস্থাতেই কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রশক্তি কিম্বা মৌলবাদীদের সমর্থনে দাঁড়ানো উচিত নয়। কেননা রাষ্ট্রশক্তি কিম্বা মৌলবাদীরা আখেরে সৃজনশীলতার বিরোধী। নতুন চিন্তা ভাবনা এবং বাক স্বাধীনতার বিরোধী। এরই বিপ্রতীপে নতুন চিন্তাভাবনা এবং বাক স্বাধীনতা ছাড়া সৃজনশীল ব্যক্তিদের বেঁচে থাকা অসম্ভব । আজ যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তি এবং মৌলবাদীর সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন - আগামী দিনে অনিবার্যভাবে তাদেরও কণ্ঠরোধ করা হবে। হবেই। হাসিনার সময়েও একই অবস্থা হয়েছে। এখনও তাই হবে। হাসিনার সময়েই তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছিল। তখন যারা হাসিনাকে সমর্থন করেছিলেন আজ তারা নিজেরাও বিতাড়িত। এই হয় ... এটাই ভবিতব্য।
আরও পড়ুন...