সদ্যসমাপ্ত দিল্লী নির্বাচন: ত্রিপুরাবাসী এবং দিল্লীবাসীর পার্থক্য

প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী

দিল্লী বিধানসভা নির্বাচন আমাকে আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ত্রিপুরা এবং দিল্লীর জনগণের মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক কোথায়। স্পষ্ট হল কেন দুই রাজ্যের মানুষের মধ্যে কাউকে প্রথম শ্রেণীর আর কাউকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করেন অনেক বিখ্যাত, অতিবিখ্যাত মহান সুমহান নেতা-ব্যক্তি। মনে রাখতে হবে, দুটোই রাজ্য হলেও ত্রিপুরা একটি পূর্ণরাজ্য আর দিল্লী বলতে গেলে আধা-রাজ্য। কেননা দিল্লীর হাতে পুলিশ নেই, সেখানকার আইনশৃংখলা কেন্দ্রের দায়িত্বে। আর সাংবিধানিক প্রধান উপ-রাজ্যপাল। আমাদের রাজ্যের মতো রাজ্যপাল নন।

এখন কথা হল, বিধানসভা নির্বাচন দিল্লীতে যেমন হয় তেমনি ত্রিপুরাতেও হয়। এখানে ষাট তো ওখানে সত্তর আসন। এখানে পঁচিশ লক্ষের মতো তো ওখানে দেড় কোটির মতো ভোটার। দু-রাজ্যেই ছোট-বড় অনেকগুলি দলই ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকে।

ত্রিপুরার মানুষের জন্য যা শিক্ষনীয় তা হল, দিল্লীতে ভোটাররা নিজের ওজন বোঝে, যা ত্রিপুরার ভোটাররা বুঝতে পারেনা। দিল্লীর ভোটাররা নিজের মূল্য হিসাব করতে জানে, ত্রিপুরার ভোটাররা জানেনা। ফলে প্রতিটি নির্বাচন থেকে দিল্লীবাসী লাভবান হন, ত্রিপুরাবাসী হতে পারেননা।

সবাই দেখেছেন দিল্লীতে মোট প্রদত্ত ভোট ষাট শতাংশেরও কম অথচ ত্রিপুরায় সাধারনতঃ নব্বই শতাংশের ওপরে থাকে।

মূল বিষয় হল দিল্লীর ভোটারদের মন জয় করতে এক একটা রাজনৈতিক দল অথবা প্রার্থীকে কাল-ঘাম ছোটাতে হয়। প্রচারের সময় এক একজন ভোটারকে শুধু নিজের কথা শোনাতেই দম বেড়িয়ে যায় বাবুমশায়দের। ভোটারদের শ্রেণী অনুযায়ী ফাইভ স্টার, থ্রি স্টার অথবা অন্য হোটেলে প্রচারমূলক-পার্টি দিতে হয়, অঢেল খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়, নানাভাবে হাতে-পায়ে ধরে বোঝাতে হয়।

প্রায় মাসব্যাপী নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন বিভিন্ন দলের যেসমস্ত সভা হয়েছে সেগুলির অধিকাংশতেই লোক জমায়েত এক হাজারের কম। এক নেতা টেলিফোনে বলছিলেন তার বিধানসভায় একদিন একটি বিশাল সভার কথা। নিজেই জানান তাতে প্রায় বার'শ লোক অংশ নেয়।

দিল্লীর জনতা রাজনৈতিক দলগুলোকে সারাবছর হিসাব দিতে ব্যস্ত রাখে। তারা নিজেদের সস্তার পণ্য বানায়না। কোন নেতা অথবা দল খামখেয়ালীভাবে একটা সভার ডাক দিল আর মানুষ অমনি সব ফেলে দৌঁড় লাগালো - এমনটা তারা করেনা। দিল্লীবাসি নিজেকে নেতার গোলাম না বানিয়ে বরং নেতাকে সবসময় আঙুলের ডগায় রেখে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করে। সেজন্যই দিল্লী এত উন্নত, দিল্লীর জনতা অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যা বাকি ভারত, বিশেষ করে, ত্রিপুরাবাসী কল্পনাও করতে পারেনা।

দুর্ভাগ্য ত্রিপুরার যে এখানকার মানুষ কারুর কাছে সামান্য ক্ষমতা আছে বুঝতে পারলেই মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। গনতন্ত্রে নিজের গুরুত্ব কী বিশাল এবং রাজনৈতিক দল-নেতা যে তারই সেবা করতে দায়বদ্ধ - তা বোঝার ক্ষমতাই হয়নি এখানকার ভোটারদের। কেউ এই দলের দাস, তো কেউ ওই দলের দাস। স্বাধীন ভোটার কে চেনা মুসকিল। মানুষের চিন্তা-চেতনা যেন দল অথবা নেতার কাছে বন্ধক রাখা আছে।

অনেকক্ষেত্রে আদেশের সুরে সভা-সমিতিতে যোগদানের জন্য বলা হয়, না গেলে কৈফিয়ত চাওয়া হয়। মানুষও মেরুদন্ড বাঁকা করে কৈফিয়ত দিয়ে কোনরকমে মুক্তি পায়।

দিল্লী-কর্নাটক-তামিলনাড়ু-গুজরাট-মহারাষ্ট্র-পাঞ্জাব-হরিয়াণায় কেউ এমনটা কল্পনাও করতে পারেনা। ফলে সেখানকার মানুষ সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে।

সবাই টিভি-তে দেখেছেন, দিল্লীতে এক একজন ভোটারের দাম কত বেশি। মাত্র দেড়'শ-দু'শ ভোটারকে বোঝাতেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী-নেতারা নিজের বাড়িতে রাজকীয় আয়োজন করেছেন। কত আদর-সৎকার! প্রত্যেকের আরামদায়ক ব্যবস্থায় আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা।

আমাদের রাজ্যে ট্রাকে-বাসে ঠাসা করে অনেকটা পল্ট্রির মতো মানুষ এনে ফেলা হয় এসি গাড়ি চড়ে আসা নেতাদের ভাষন শুনতে। নেতাও খুশি মানুষও খুশি। জনতার এর চেয়ে বেশি রেট লাগেনা। তৃতীয় শ্রেণীর ট্রিটমেন্ট পেলেই জীবন ধন্য। তার মধ্যে যদি সবার সামনে কোন নেতা একবার পিঠে হাত রেখে দেয় তাহলেতো আর কথাই নেই!

দিল্লীর সঙ্গে আমাদের রাজ্যের এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য যে দিল্লীবাসী নিজেকে প্রথম শ্রেণীতে রাখে আর ত্রিপুরার মানুষ তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদায় সন্তুষ্ট।

দেশের রাজধানীর সঙ্গে যতটুকু ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমার হয়েছে এবং নির্বাচনকে যতটুকু পর্যবেক্ষন আমি করতে পেরেছি তার থেকে এই যাত্রায় এটুকু নিশ্চিৎভাবে বলতে পারি ত্রিপুরা যদি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আসল মর্যাদা পেতে চায় এবং জনগণ যদি নিজের জীবনে দিল্লীর মতো সুবিধা ভোগ করতে চায়, তো প্রথমে দিল্লীবাসীর মতো স্বাভিমানী হতে হবে। আত্মমর্যাদাবোধ জাগাতেই হবে। রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার ওপর নির্ভরতা সমাপ্ত করে তাদের নিজের ইচ্ছাধীন করতে হবে।

নেতার বাড়িতে জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী অমুক-তমুকের নিমন্ত্রণ খেয়ে ফেসবুকে ছবি পোষ্ট করে জীবন ধন্য হয়ে গেলে কোন জাতি এগোতে পারেনা। সারাদিন শুধু নেতাবন্দনা, সারাদিন লজ্জাহীনভাবে অকর্মন্য নেতার প্রচার নিজের ব্যক্তিত্বের অপমান। একটি অন্ততঃ এটুকুও ভাবেনা ওই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে নেতা হওয়ার যোগ্য কিনা।

আমি চাই ত্রিপুরা যেমন দিল্লীর মত উন্নত হোক, তেমনি ত্রিপুরাবাসীও দিল্লীবাসীর মত স্বাভিমানী হোক।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
মন্তব্যের তারিখ (Posted On)মন্তব্যকারির নাম (Name)মন্তব্য (Comment)
13.02.2020ManasDear Prasenjit, well written.. well if we analyse the reason behind the difference in mindset of ppl. we will find that In a city like Delhi ppl. dont have to depend on politicians for Job , there are ample opportunities for a decent livelihood. But since we dont have a strong pvt sector ..ppl. are more dependent on Netas for jobs..causing more & more educated youth to surrender before politicians.
12.02.2020প্রিয়জিৎ দাসগণতন্ত্রের মূল কথা বলেছেন ! গণতন্ত্র নেই l নেতাতন্ত্র চলছে ত্রিপুরায় l আমরা নিজেদেরকে অন্যের কাছে বিকিয়ে দেই l ভোটের আগে যেমন নেতারা পায়ে ধরে, ভোটের পরেও এমন চাপে রাখা দরকার l প্রতিটা নাগরিক তার অধিকারের জন্যে কথা মাথা উঁচু করে যখন বলতে শিখবে তখনি ত্রিপুরার মানসিকতা আর চিত্র সবটাই পাল্টাবে l
11.02.2020HARAJIT GHOSHNice Article Sir. It will take a lot more time...
10.02.2020সুস্মিতা দাসখুব সুন্দর লিখেছেন স্যার। আমার মনে হয় ত্রিপুরার মানুষ দিল্লির মানুষের মতো হতে এখনও অনেক দেরী আছে।