শুধু সিপাহীজলা জেলার বিভিন্ন আদালত থেকে ১৪০ ড্রাগস মাফিয়ার মুক্তি ঘিরে বিতর্ক !

বিশেষ প্রতিনিধি

February 9, 2025

২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে শুধু সিপাহীজলা জেলার বিভিন্ন আদালত থেকে ১৪০ জনের মতো ড্রাগস মাফিয়া জামিন পেয়ে গেছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাড়া পেয়ে গেছেন পুলিশ তাদেরকে ড্রাগস সহ ধরার পরেও এটা প্রমান করতে পারেনি তারা ড্রাগস মাফিয়া বা ড্রাগস-এর ব্যবসার সাথে জড়িত। আবার বেশ কয়েকজন ছাড়া পেয়ে গেছে পুলিশ চার্জশিট যথা সময়ে দিতে পারেনি। আবার এমন বেশ কয়েকজন ড্রাগস মাফিয়া ছাড়া পেয়ে গেছে পুলিশ আদালতে যুতসই তথ্য প্রমান পেশ করতে পারেনি। এমনও বেশ কয়েকজন ড্রাগস মাফিয়া আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে যাদের সাক্ষী দেওয়ার কথা ছিল তারা সাক্ষী দিতে আদালতে যায়নি।

সাধারনত এন ডি পি এস- আইনে কেউ ড্রাগস সহ ধরা পড়লে তার জামিনে মুক্তি পাওয়াটা খুবই কঠিন। অন্তত ১৮০ দিনের আগে জামিন মঞ্জুর হয়না। ত্রিপুরা উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি অরিন্দম লোধ এর সিঙ্গেল বেঞ্চ থেকে এই বিষয়ে একটা যুগান্তকারী জাজমেন্ট রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে এত সব কঠিন আইনি বিধিনিষেধের পরেও হঠাৎ করে গত ২০২৪ সালের মে মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিশালগড় সহ জেলার বেশ কিছু কোর্ট থেকে হঠাৎ করে একের পর এক অন্তত ১৪০ জন ড্রাগস মাফিয়া ছাড়া পেয়ে যায়। এই নিয়ে রাজ্য সরকার বাস্তুনিস্ট কোন তদন্ত করেছে কিনা জানা যায়নি।

ত্রিপুরা পুলিশ এর মহানির্দেশক অমিতাভ রঞ্জনকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা ইনফো ডটকম এর তরফে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। ডিজিপি অমিতাভ রঞ্জন স্বীকার করেছেন এমন একটা বিষয়ের উপর কথা উঠেছে। পুলিশ এই বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখছেন। একাধিক মুক্তি প্রাপ্ত ড্রাগ মাফিয়ার জামিনের আবেদন বাতিলের দাবিতে পুলিশ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

জানা গেছে বিষয়টি ত্রিপুরা পুলিশ ছাড়াও ত্রিপুরা হাইকোর্টের নজরেও গেছে।

যতদূর জানা গেছে, পুলিশ ছাড়াও বিচার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত একটি চক্র এই ‘স্ক্যাম’- এর সাথে যুক্ত। বেশ কিছু পি পি, এ পি পি অবশ্য এই ঘটনার পরে বিশালগড় সহ জেলার বিভিন্ন আদালত থেকে বিতারিত হয়েছেন। কিন্তু কোন বিচারকের বিরুদ্ধে কোন আইনি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহনের খবর শোনা যায়নি।

জানা গেছে, এর আগে উত্তর জেলার একটি আদালত থেকে মায়ানমার-এর এক কুখ্যাত ড্রাগস মাফিয়া ছাড়া পেয়ে দেশে চলে গেছে। এক বছর আগে একই সাথে দুই মায়ানমার-এর বাসিন্দা বিপুল পরিমান ড্রাগস সহ উত্তর জেলার পুলিশ সুপার-এর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানে ধরা পড়েছিল। একজন বিদেশী রাষ্ট্রের ড্রাগস মাফিয়া বিপুল পরিমানে ড্রাগস সহ ধরা পড়ার পরেও কিভাবে সে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে এই প্রশ্নেরও আজ পর্যন্ত কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

একই রকমভাবে জবাব পাওয়া যাচ্ছেনা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহ-এর ড্রাগস-এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করার জন্যে পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আহ্বান জানানোর পরেও কিভাবে আদালত থেকে এসব কুখ্যাত ড্রাগস মাফিয়ারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন?

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা নিজেও প্রতিটি প্রশাসনিক বৈঠকে পুলিশকে ড্রাগস কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ জারী রাখতে আবেদন জানিয়ে থাকেন। কিন্তু তার পরেও ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা শহর থেকে শুরু করে ইদানিং অজ পাড়া গায়ে পর্যন্ত ড্রাগস বানিজ্যের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এবং ক্রমাগত রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা গুলিতে ড্রাগস এর কুপ্রভাবে এরাজ্যের তরুণ সমাজের আজ কর্মদক্ষতা হারিয়ে যাচ্ছে। স্কুল ড্রপ আউটের সংখ্যা বৃদ্ধি সহ ড্রাগস-এর কুপ্রভাবে গ্রামে শহরে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন জনিত যান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাও।

গত এক দশক আগেও ত্রিপুরাতে হিরোইন ব্রাউন সুগার ইয়াবা টেবলেট এতটা সহজ লভ্য ছিলনা ইদানিং যেভাবে এসব ড্রাগস –এর হোম ডেলিভারীর কাজ সহজলভ্য হয়ে গেছে। রাজধানী আগরতলা সহ মফঃস্বলের প্রতিটি জায়গায় বিভিন্ন নামের ড্রাগস আজ নেশাখোর যুবকদের হাতের নাগালের মধ্যে। পুলিশ মাঝে মধ্যেই এসব নেশাখোরদের পাকড়াও করলেও এগুলির বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত চাইদের খুবই কমই পাকড়াও করতে পারছেন। এখন পর্যন্ত পুলিশের কোন স্তর থেকেই ড্রাগস-এর বিরুদ্ধে ‘মরণ কামড়’ দেওয়ার মতো করে অভিযান দেখা যায়নি। সর্বত্র অভিযোগ, পুলিশের একটি অংশ নিজেরাই এসব ড্রাগস বানিজ্যের চাইদের ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছেন। অথচ সিপাহিজলা সীমান্ত এলাকার যেসব জায়গা থেকে ত্রিপুরার ড্রাগস বানিজ্যের আসল কারবারটি চলছে তার পেছনে কারা এটি এ রাজ্যের বা দিল্লীর শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তাদের না জানার কথা নয়। মাঝে মধ্যে তাদের লোকজন ড্রাগস সহ রাজ্যে বা বহিরাজ্যে ধরা পড়ে গেলে কাদের কাছে তাদের ছাড়াবার জন্য টেলিফোন আসে এটাও পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের না জানার কথা নয়। তাহলে এরাজ্যের মাদক কারবারের আসল চাইরা কেন ধরা পড়ছেনা এই প্রশ্ন আজ এরাজ্যের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে।

সৎ পুলিশের অনেক অফিসারও ব্যাক্তিগত আলাপাচারিতার এটা স্বীকার করেন শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। আর মূলত এই কারনেই সোনামুড়া থেকে গাঁজা ভর্তি ট্রাক চোরাইবাড়ি গেইটে ধরা পড়ে। মধ্যবর্তী এক ডজন থানার আধিকারিকদের হাতে চেকিং-এর সময় কেন গাঁজা ভর্তি ট্রাক ধরা পড়েনা এই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন এটাও হতে পারে চোরাইবাড়ি গেইটে মালবাহী ট্রাকে নেশাদ্রব্য আছে কিনা তার দ্রুত তল্লাসীর জন্যে কেন পুলিশের পরিকাঠামো বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। মাত্র দশ/বারোজন পুলিশ কর্মী দিয়ে চলছে চোরাইবাড়ি গেইটে গাঁজা ও নেশা দ্রব্য পরিবাহী যানবাহনের তল্লাসী। আর এজন্য সাধারণ নিরপরাধ যান মালিকরা পুলিশী তল্লাশীর বিরম্ভনায় ভুগছেন। অথচ বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকাঠামো তৈরির জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার যা যা প্রয়োজন তা করার কথা শুনিয়েছেন। এমনকি পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজে একবার চোরাইবাড়ি গেইটে গিয়ে গাঁজা কিভাবে বহিঃরাজ্যে পাচার হচ্ছে বা হিরোইন, ব্রাউন সুগার, ফেন্সিডিল কিংবা ইয়ারা টেব্লেট ত্রিপুরাতে ঢুকছে তা বোঝতে গিয়েছিলেন। তিনি চোরাইবাড়ি প্রবেশ দ্বারে যানবাহন তল্লাসীর জন্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকাঠামো তৈরি গল্প বলেছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও বিজ্ঞান ভিত্তিক এসব পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। উল্টো মাঝে মধ্যে ড্রাগস সহ ধৃত নেশা কারবারীরা আদালত থেকে অনায়াসে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী, স্বরাস্ট্রমন্ত্রী এমনকি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী নেশার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’-এর শ্লোগান দিচ্ছেন। ত্রিপুরায় নেশা কারবারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহনের লক্ষ্যে ‘এনফোর্মমেন্ট ডাইরেক্টর’-এর একটি অফিসও খোলা হয়েছে। গত একবছরে তারা কি করেছে (?) এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। সম্প্রতি লোক দেখানো কিছু অভিযান ই ডি চালালেও একজনও নেশা কারবারীকে পাকড়াও করতে পারেনি। একই রকমভাবে আদালতের মাধ্যমে নেশা কারবারীদের কিংপিনদের একজনকেও সাজা হয়নি। ছোটখাটু অপরাধীদের ধরে ধরে ত্রিপুরার জেল গুলি ভর্তি করা হচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে পুলিশ, টি এস আর, সি আর পি এফ, বি এস এফ নিয়ে গিয়ে গাঁজা গাছ কাটার ছবি তুলে প্রেস মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গল্পের গরুকে গাছে চড়িয়ে মাঝে মধ্যে বলা হচ্ছে একই জায়গা থেকে পঞ্চাশ হাজার গাঁজা গাছ নষ্ট করা হচ্ছে। হেরোইন ব্রাউন সুপার ধরা পড়লে প্রেস কনফারেন্স করে বলা হচ্ছে লক্ষ বোতল ফেন্সিডল ধরা পড়েছে। এমনকি কোটি টাকার হিরোইন, ব্রাউন সুগার বিভিন্ন নেশার টেব্লেট ধরা পড়ার গল্প কিছুদিন পরে পরে মিডিয়ার সামনে আনা হয়। এমনকি এন ডি পি এস আইন লঙ্ঘন করে নেশাখোর ও নেশাকারবারীদের ছবি ভিডিও প্রচার করে প্রেস কনফারেন্স করা হয়। শত শত গাড়ি এন ডি পি এস কেইসে ধরা পরে এখন রাজ্যের বিভিন্ন থানায় নষ্ট হচ্ছে। অথচ এগুলি নিয়ে রাজ্য পুলিশের কর্তা ব্যক্তিদের কোন অ্যাকশান নেই।

প্রশাসনিক কোন হেলদোলও নেই চোরাইবাড়ি গেইটে বিজ্ঞান ভিত্তিক তল্লাসী পরিকাঠামো গড়ে তোলার। এমনকি চোরাইবাড়ি প্রবেশ দ্বার বাদেও মায়ানমার থেকে মিজোরাম হয়ে ধলাই ও উত্তরজেলার যেসব ফাঁড়ি রাস্তা হয়ে এসব ড্রাগস ত্রিপুরাতে ঢুকছে সেসব রাস্তায় কোথাও যানবাহনে তল্লাসী হয়না। দামছড়া ব্রীজের কাছে মাঝে মধ্যে পুলিশ যানবাহন চেক করে থাকে। বাদ বাকি এগারটি ফাঁড়ি পথ দিয়ে মিজোরাম থেকে বিনা বাঁধায় নেশা পণ্য বাহী ড্রাগস ত্রিপুরাতে ঢুকছে। আর রাজধানী আগরতলায় বসে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা নেশা বিরোধী অভিযানে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ মেনে কাজ করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.