রাজন্য আমলের স্মৃতি গুলি কি ধরে রাখা যায় না?
প্রদীপ চক্রবর্তী
রাজন্য আমলের স্মৃতি গুলি কি ধরে রাখা যায় না?১৯০৩ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতাল যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ভিএম।এখনো লোকের মুখে মুখে ভিএম। পরবর্তী সময়ে ভিএম পরিবর্তিত হয় আইজিএম হাসপাতালে। ভিএম হাসপাতাল স্হাপিত হয়েছিল ১৯০৩ এড়িয়ে। অর্থাৎ ১৩৯৩ ত্রিং এ।
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে স্হাপিত এই হাসপাতাল দীর্ঘ সময় ছিল রাজধানীতে বটেই রাজ্যের অন্যতম হাসপাতাল। এখানে ছুঁটে আসতেন বিপন্নপ্রায় লোকজন, চিকিৎসা ও হত ভাল ও তৎকালীন উন্নতমানের।এই ভিএমে চিকিৎসিত হয়নি এমন লোকজনের সংখ্যা খুবই কম। এখানেই পৃথিবীর আলো দেখেছে অধিকাংশ রাজধানীবাসী। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সম্ভাব্য প্রসূতি মায়েরা ও ভিএমে আসতেন।
ভিএম র প্রসূতি বিভাগ ছিল উন্নত। গর্ভ কালীন কিংবা প্রসূতি কালীন মৃত্যুর হার ও ছিল হাতেগোনা।ওখানকার সেবিকাদের মধ্যে ছিল ভীষন দরদ। চিকিৎসকরা ও ছিলেন প্রকৃত অর্থে দরদী,দক্ষ।সিজারতো তখন হত ই না বলা চলে।এক একেকজন নাই,সেবিকা ছিলেন দক্ষ।চিকিৎসকরা দক্ষ নাই বা সেবিকাদের কাছ থেকে মতামত নিতেন।
এদের মধ্যে সাধনা সিনহার নাম সবার আগে উল্লেখ করতে হয়।তিনি যেভাবে সন্তান/সন্ততি প্রসব করাতেন প্রায় বিনা যন্ত্রনায় তার প্রশংসার দাবি রাখে। একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। গর্ভ বতীর পরীক্ষা করে চিকিৎসক বললেন সিজার লাগবে।সাধনা সিনহা দ্বিমত পোষণ করলেন।এনিয়ে দুজনের তর্ক। লোকজন জমে যাওয়ার উপক্রম।
সাধনাদি রোগীনীর স্বামীকে আড়ালে নিয়ে বললেন ভাববেন না।বলেই প্রসূতি সম্ভাব্য মা কে দ্বিতলে নিয়ে গিয়ে সেলাইন পুশ করে ২০ মিনিটের মধ্যে লেবার রুমে নিয়ে গেলেন।৩০ মিনিট বাদেই সাধনা দি হাসি মুখে বেরিয়ে এলেন লেবার রুমে থেকে। বললেন সব ঠিক।মেয়ে হয়েছে।নর্মাল হয়েছে।কেবিনে নিয়ে গিয়ে বললেন কাল ছুটি। পরদিন যথারীতি ছুটি।
অবাক হলেও সত্যি ,সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল মং ১৬ টাকা।ভাবা যায়! উল্লেখ্য করা হল ভিএম র চিকিৎসা ব্যবস্থার নদীর তুলে ধরতে।
কোন এক সময়ের ভিএম কিন্তু এখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে ৬ তলা মাথা তুলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ডায়ালিসিস ইউনিট ওখানে।আইসিও ও ওখানে। রয়েছে অন্যান্য ইউনিট ও। লোকে বলে আইজিএমের চক্ষু বিভাগটি উন্নত মানের। চিকিৎসকরা ও অল্প বয়সের হলেও দক্ষ। পরীক্ষা নিরীক্ষা র ইকুইপমেন্ট ও সর্বাধুনিক। তাই কাকভোর থেকে লাইন পড়ে। অন্যান্য বিভাগ গুলিতে ও উপচেপড়া ভিড়।
অনেকেই বলেন আইজিএমের চিকিৎসা, ব্যবস্হাপনা জিবি থেকেও অনেক উন্নত মানের চিকিৎসা হয়। ব্যবস্হাপনা ও ধোপদুরস্ত। মেঝেতে কোন রোগীর ঠাঁই হয় না। জিবি তে মেঝেতে রোগী রাখা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।গত মে মাসে ছুটে যেতে হয়েছিল জিবিতে।আমার ঠাঁই দেয়া হয়েছিল মেঝেতে তাও আবার টয়লেটের দরজার সামনে।উৎকট ও কিম্ভুতকিমাকার আবেশে বিনা অপারেশনে নাড়ীভূড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম। রাউন্ডে এসে আমার এই অবস্থা দেখে প্রবীন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রদীপ ভৌমিক-র চোখ প্রায় ছানাবড়া। তাৎক্ষণিক ভাবে আমাকে রেফার করে দিলেন। বেঁচে গেলাম ওই যাত্রায়।
আভিজাত্য ছিল ভি এম র, আইজিএমের।এর মূল প্রবেশ পথে অর্থাৎ তিরিশ বছর আগে যা ছিল জরুরি বিভাগের প্রধান প্রবেশ পথ তার বাইরের অংশ টি আভিজ্যাতের জানান দেয় এখনো। ওকি রাজন্যবর্গ যুগের স্মৃতি বহন করছে।
কিন্তু সেটি হয়তঃ বেশি দিন থাকবে না। এর দু দিকে ই ভাংচুর চলছে,চলছে জেসিবি।বুলড্রজার চলার অপেক্ষায়।
এই স্মৃতি ধরে রাখার কি কোন উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না রাজ্য সরকার।
এই তো গেল একদিক। অন্যদিকে ঘোড়াশাল টিও ইচ্ছে করলে হয়ত সযত্নে ধরে রাখা যায়। উওর গেট থেকে রাজবাড়ীতে যাওয়ার দুদিকেই ছিল ঘোড়াশাল।এখনো সেখানে জানান দিয়ে যায় ঘোড়াশাল র অস্তিত্বের কথা। থাম্ব বা পিলার গুলি তে শোনা যায় হারানো দিনের ঘোড়ার খুরের টগবগানির আওয়াজ।রাজন্য যুগের দিন তখন।কোঅপারেটিভ ভবন থেকে উওর দিকে যাওয়ার পথের ডানদিকে ওই সব পিলার ব থাম্বস রয়েছে। রয়েছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে লম্বালম্বি দেয়া ছাদ।
কিন্তু এগুলোর এখন অস্তিত্ব সংকট। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ছাদে গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও ভেঙে পড়ছে দেয়াল। একদা রাজন্য শাসিত এই রাজ্যের রাজন্যবর্গ যুগের এই স্মৃতি গুলি ধরে রাখা যায়।এ শুধু রাজ্য সরকারের দায়িত্ব নয়। রাজপরিবারের ও দায়িত্ব রয়েছে। প্রদূৎ কিশোর মালঞ্চনিবাসকে রিসোর্ট বানাচ্ছেন। মোটা অংকের অর্থ ইতিমধ্যেই ব্যয়িত হয়েছে।আরো হবে বলে খবর। এই যে ঘোড়াশাল এটা তো তাঁর পূর্ব পুরুষেরই করা। তবে এক্ষেত্রে প্রদূৎ কিশোর এটি ধরে রাখার উদ্যোগ নেবেন না? গুজরাটের বরোদায় কিন্তু এসব সযত্নে ধরে রাখা হয়েছে। পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেখানে। এখানে ও তো তেমনি হয়। আস্তাবল ময়দানকে বিবেকানন্দ ময়দান করা হয়েছে।এটি ভাল কাজ।
এই ময়দানেই রাজ রাজাদের ঘোড়া বিচড়ন করতে। সন্ধ্যায় এগুলো নিয়ে আসা হয় এই ঘোড়াশাল এ।এগুলি তো স্মৃতি। এখনও সময় আছে।ধরে রাখা হউক রাজন্যবর্গ স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি।
ভুলে গেছেন কি পথিকের, পথচলাচলে সেই সব রাস্তার কথা? মোটরষ্টেন্ড থেকে কামান চৌমুহনী, কামান চৌমুহনী থেকে সূর্য চৌমুহনী, জেকসন গেট থেকে আর এম এস চৌমুহনীর রাস্তার দুধারের সেই সব পিলার, স্তম্ভ যার উপর ছিল ছাদ। রোদবৃষ্টি তে পথিকবর এখানে দাঁড়াতে পারতেন, পারতেন ক্ষনিকের বিশ্রামপড়া নিতে। কোন বাধা বিঘ্ন ছিল না। ক্লান্ত পথিক বুকভরে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারতেন।
রাজদরবারে দূর্গম পাহাড়ী জনপদ থেকে যে সব গিরীবাসী আসতেন তাঁরা শহর দেখতে যেতেন দুদিকের বিশাল রাজবারান্দা ধরে। কিন্তু কোথায় গেল এসব? সব রাঘব বোয়াল, হাঙরদের পেটে গেছে। দিব্যি দোকান প্রসারিত করে দুহাতে মুনাফা লুটে চলেছে ওরা।
এগুলো পুনরুদ্ধার করা হবে কিনা জানা নেই, উদ্যোগ আছে কিনা তাও জানা নেই। তবে এখন শহর জুড়ে বেআইনী উচ্ছেদ পর্ব চলছে। বহু অবৈধ বাড়ীঘর, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেয়া চলছে। শহরের সৌন্দর্য বাড়ছে।
এখনতো স্মার্ট সিটির কাজ চলছে দ্রুত লয়ে। ওই সব বেআইনী দোকানপাট কেন বাদ যাবে? কেন পুনরুদ্ধার হবে না পথিকদের পথ, বিশ্রামাগার গুলি। এটাতো সময়ের ডাক। পুনরুদ্ধার হউক রাজন্য আমলের সেইসব পথ, ঘোড়াশাল, মালঞ্চ নিবাস।