ক্ষুধা নিবারন ও বেকারত্ব: করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে করনীয়
জয়ন্ত দেবনাথ
না ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, না মুখ্যমন্ত্রীর দল কারোর তরফেই গরু, ছাগল, হাঁস, মোরগ শূকর পালন, কিংবা চা, চপ বিক্রির উর্দ্ধে উঠে রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধানের চিন্তা বা চেষ্টা করা হচ্ছে না। বিজেপি দল ও দলের মুখ্যমন্ত্রীর সবার জন্যই একটাই আহ্বান-ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করুন বা স্বাবলম্বী হয়ে যান। ব্যাংক ঋণদানের বাইরে গিয়ে রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ত্রিপুরার বিজেপি দল গত বিধানসভা ভোটে ক্ষমতায় আসার আগে ভিসন ডকুমেন্টে প্রচুর লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি গুলি রূপায়নে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেই। আমি বলব ভিসন ডকুমেন্টে বর্নিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি গুলি কার্যকরী করার কোন পদক্ষেপ গ্রহনের দরকারও নেই। কেননা, ভিসন ডকুমেন্টে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি গুলির খুব বেশি বাস্তবায়নও এই মুহুর্তে সম্ভব নয়। আর করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে তো কোনভাবেই না।
এই অবস্থায় করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্যের সর্বস্তর মানুষের সামনে যে বিষয়টা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে তা হলো রাজ্যের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যাওয়ার সমস্যা, চিকিৎসা সমস্যা ও বেকারদের কাজের সমস্যা। এই অবস্থায় রাজ্যের আপামর স্কুল পড়ুয়া ও বেকার কুলের জন্যে যে ক’টি পদক্ষেপ করোনা উত্তর পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এই মুহুর্তে গ্রহন ও ফলপ্রসু করা যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছে- ১) স্কুল ও কলেজ গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অনলাইনে পাঠদানের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন।
২) সরকারী শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রাইভেট টিউশনি করার লাইসেন্স প্রদান। এক্ষেত্রে সরকার টিপিএসসি-র ধাঁচে একটি বোর্ড বা কমিশন গঠন করে সেই সব বেকারদের পরীক্ষা নিয়ে তাদের ছাত্র পড়ানোর যোগ্যতা বা ক্ষমতা অনুযায়ী লাইসেন্স প্রদান করা যেতে পারে। যার পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ানোর ক্ষমতা তাকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী পড়ানোর লাইসেন্স প্রদান। যার অষ্টম মান পর্যন্ত ছাত্র পড়ানোর ক্ষমতা তাকে অষ্টম মান, আর যার দ্বাদশ পর্যন্ত তাকে দ্বাদশ মানের লাইসেন্স এবং যেসব শিক্ষিত বেকারের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর যোগ্যতা রয়েছে পরীক্ষা গ্রহনের মাধ্যমে তাকে সেই অনুযায়ী ছাত্র পড়ানোর লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া।
সময়ে সময়ে চাইলে এসব শিক্ষিত বেকাররা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও বসতে পারবেন। এটা করা একারনেই দরকার তাহলে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষকরা গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করেন তাদের চুরিচামারি করে প্রাইভেট পড়ানোর তথ্য এসব লাইসেন্সধারী শিক্ষিত বেকারদের মাধ্যমেই শিক্ষা দপ্তরে আসবে। তাছাড়া একটা বিরাট সংখ্যক বেকারেরও কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
তাছাড়া, এমন বহু শিক্ষিত বেকার রয়েছেন তাদের বিএড ডিগ্রি নেই। তাই তাদের যত ভালভাবেই ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকুক তারা শিক্ষক পদে চাকুরীর জন্যে কোন দিনই আবেদন করতে পারবেন না। আর পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশে যা বলা হয়েছে অদূর ভবিষ্যতে এরাজ্যে অন্যান্য সরকারী দপ্তরেও চাকুরীর সুযোগ খুবই কম। এই অবস্থায় সরকারী প্রশাসনকে শিক্ষিত বেকার যারা উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বসে রয়েছেন এবং উচ্চ মেধার কারনে সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে হাস, মোরগ পালন বা চপ-এর দোকান নিয়ে বসতে চাননা তাদের জন্যে এধরনের চিন্তা ভাবনা করা যেতে পারে।
৩) এক্ষেত্রে রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর-এর ছাঁটাইকৃত ১০৩২৩ শিক্ষকদের মধ্যে যেসব শিক্ষক শিক্ষিকারা নতুন করে বেকার হয়ে গেছেন তাদের সাহায্য নিয়েও স্কুলের সবচেয়ে গরীব বা পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর একটা বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ছাঁটাই এসব অভিজ্ঞ শিক্ষকদেরও কাজে লাগানো গেলো, পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্যেও বিশেষ কোচিং এর ব্যবস্থা গ্রহন করা গেলো।
৪)তাছাড়া রাজ্যের একটা বৃহৎ অংশের দিব্যাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার জন্যে না সমাজকল্যাণ দপ্তর না শিক্ষা দপ্তর কেউই কিছু করছেননা। অবশ্য এই প্রতিবেদনে বর্ণিত এই তথ্যটি সঠিক নয় প্রমান করতে দুই দপ্তর মন্ত্রী রতন নাথকে দিয়ে অতিমারির প্রেস ব্রিফিং এ বলাতে পারেন না, না এই তথ্য সঠিক নয়। যদি এই তথ্য মিথ্যাও হয় তারপরও আমি বলবো বহু দিব্যাঙ্গ ছেলেমেয়ে রয়েছেন যারা স্কুলে যেতে পারছেনা, সরকার যেন করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে বাড়ী বাড়ী শিক্ষক পাঠিয়ে তাদের ঘরে বসে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন।
৫)এছাড়া করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে কৃষিক্ষেত্রের গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেরও গুরুত্ব আগের চেয়ে বেশ কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তাই এখন থেকেই ত্রিপুরা সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের জন্যে উপযোগী বিভিন্ন স্কিল ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে পারেন এরাজ্যের বেকার ছেলে মেয়েদের জন্যে। কেননা, চিকিৎসক শুধু নয়, নার্স ও বিভিন্ন প্যারা মেডিকস-এর সঙ্কট ও প্রয়োজনীয়তাও দেশ ও বিশ্বজুড়ে আগামী দিন করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে বেশ কয়েক গুন বেড়ে যাবে। তাই এরাজ্যের বেকার ছেলেমেয়েদের জন্য ব্যাপক হারে নার্স ও বিভিন্ন প্যারামেডিক্যাল সাবজেক্ট খুলে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের স্কিল ট্রেনিং দিয়ে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর জন্যে পাঠানো যেতে পারে। যা কেরালা সরকার অন্তত ৩০ বছর আগেই করেছে।
এক্ষেত্রে আমার একটিই অনুরোধ। দলবাজি করলে চলবে না, যে বেকার যে ব্যাপারে ট্রেনিং নিতে চাইবে তাকে সেইসব বিষয়েই ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। সেক্ষেত্রে আবার প্লেসম্যান লিংঙ্ক ইত্যাদির নাম করে বাইরের কিছু কোম্পানীকে পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিয়ে এগুলে হবেনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র ‘ভোকাল ফর লোক্যাল’ শ্লোগানকে সামনে রেখে রাজ্যে বর্তমান যেসব স্কিল ট্রেনিং প্রোভাইডার সরকারী ও বেসরকারী স্তরে রয়েছে তাদেরকে কাজে লাগিয়েই এই কাজগুলি করাতে হবে। তার ফলে স্থানীয় স্কিল ট্রেনিং প্রোভাইডাররা যেমন বাঁচবে পাশাপাশি স্থানীয় হাসপাতাল ও নার্সিং হোম সহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিও যোগ্য লোক পেয়ে যাবেন। কেননা, করোনা মহামারী উত্তর পরিস্থিতিতে কিছু বছর মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে দু’বেলায় দু’মুটো খাবার ও একটু স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া। তাই ভবিষ্যৎ চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে এখন থেকেই খাদ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে কৃষিকে প্রাধান্য প্রদান ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে দক্ষ কর্মী দল তৈরির উপর জোর দিতে হবে। আর এই সব সেক্টরের সাথে সাথে চালু ব্যবসা বাণিজ্য ও পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলিকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই লক্ষ্যে রাজ্য সরকারকে একটি নিবিঢ় কর্মসূচী তৈরি করে এগুতে হবে। অন্যথায় করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্যে বেকার বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যভাব জনিত সমস্যা ভয়াবহ আকারে নিতে পারে।
তাছাড়া, করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়ানক ভাবে কঠিন হবে এটা বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কই শুধু বুঝতে পারছেন এমনটাই নয়। গ্রামগঞ্জের সাধারন মানুষও বুঝে গেছেন করোনার কারনে নিকট ভবিষ্যতে রুজি রুটির উপর একটা ব্যাপক আঘাত আসতে বাধ্য। গত তিন মাসের লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকেই খেটে খাওয়া মানুষের এটা বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু অসহায় সংখ্যা গরিষ্ঠ গরীব মানুষের রাজ্য ত্রিপুরায় বিজেপি-আই পি এফ টি জোট সরকার করোনা উত্তর পরিস্থিতিতেও বেকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্মহীন মানুষকে শুধু এটা বুঝাচ্ছেন যে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কিছু একটা করতে। কিন্তু সরকারী প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা একবারও এটা তলিয়ে দেখছেন না ব্যাঙ্ক ঋণ মঞ্জুর করলেই কারোর পক্ষে করোনার এই কঠিন সময়ে একটা নয়া ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তার জন্যে বাজার থাকা চাই। এরাজ্যে এমন কি জিনিসের বাজার রয়েছে যে সেই সেক্টরে এক সাথে এক হাজার লোকের পক্ষে একই ব্যবসা চালু করা যেতে পারে?
তাছাড়া ম্যানুফেকচারিং সেক্টরে- একমাত্র রাবার ছাড়া কোন কাঁচামালই এরাজ্যে নেই। ধূপকাঠির শলার ব্যবসার কথা আজ ৩০ বছর ধরেই শোনে আসছি। আনারসের কথা ইদানিং খুব বেশী শুনছি। আনারসের জোগানের অভাবে ত্রিপুরার একমাত্র ফল সংরক্ষণ কারখানাটি বহুদিন আগেই বন্ধ হয়েগেছে। একবারও প্রশাসনের সংশ্লিস্ট কর্তা ব্যক্তিরা খতিয়ে দেখেছেননা যে ত্রিপুরায় যে পরিমাণে বাঁশ বা আনারস উৎপাদন হয় তা দিয়ে কত পরিমাণে ধূপকাঠির শলা কিংবা হস্ত কারু শিল্পের জিনিস তৈরি হতে পারে। বা যে পরিমাণ আনারস সারা বছরে উৎপাদিত হয় তা দিয়ে ক’টি আনারসের জুস ফ্যাক্টরী চালু করা যেতে পারে। স্বস্তা রাজনীতির লক্ষ্যে যুগ যুগ ধরে আমাদের রাজ-নেতারা এসব বলে বেকারদের পিছনে ঠেলেছেন। তাই করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্য ও দেশের মানুষের সামনে যেখানে দু’বেলার খাওয়ার সংগ্রহ করাই আগামীর দিন গুলিতে কঠিন হয়ে পড়বে তখনও বলা হচ্ছে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে নয়া ব্যবসা শুরু করুন। অথচ যাদের ব্যবসা রয়েছে সেগুলিই চালু রাখা দুস্কর হয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্কে গেলে লোনের জন্যে গ্যারান্টার না চাওয়া হলেও, ঋণের টাকা ফেরৎ-এর নিয়ম বিধি আগের মতোই রয়েছে। কোন কোন ব্যাঙ্কে সুদ একটু কমিয়ে চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যে কায়দা কানুনের কথা বলা হচ্ছে তা মোটামুটি সবই আগের মতোই। অর্থাৎ আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে ৩ লাখ কোটি টাকার বিনা গ্যারান্টিতে ব্যবসায়ি বা বেকারদের লোনের নামে দেওয়ার যে গল্প প্রচার করা হচ্ছে তা যে কোনভাবেই ফলপ্রসূ হবেনা তা বলাই বাহুল্য। ক’দিন বাদে অবশ্য সরকার এমন তথ্য সামনে নিয়ে আসতে পারেন তিন লাখ কোটি টাকার এই প্রকল্প সুপার হিট হয়েছে। বলা হতে পারে দশ কোটি বেকারের কর্ম সংস্থান হয়ে গেছে। আমি তথ্যের এই জাগলরীর জন্যে কাউকে দোষারূপ করছিনা। দিল্লীর মসনদে বসে কংগ্রেসও এমনটাই এতবছর করে গেছে। তাই দাবী উঠেছে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যেন বেকারদের জন্যে কর্মসংস্থানের কথাটি চিন্তা করা হয়।
তাই করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যে চিকিৎসা সুবিধা, শিক্ষার নয়া পরিকাঠামো তৈরি, বেকারদের কর্মসংস্থান ও রাজ্যের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এক্ষুনি একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে ত্রিপুরা সরকার ৪৮০২ কোটি টাকা প্রাপ্তির যে সম্ভাবনার কথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিপ্লব কুমার দেব ঘোষণা করেছেন তাকে কাজে লাগিয়ে করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্যে সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে এবং বেকারদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যে কাজগুলি এখন থেকে অগ্রাধিকার এর ভিত্তিতে করা যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছেঃ-
১)যেসব বেকার পরিবারে জমি রয়েছে তাদের বিনামূল্যে সরকারীভাবে সার, বীজ, সেচ, কীটনাশকের ব্যবস্থা করে তাদেরকে কৃষি কাজে উৎসাহ দেওয়া। এবং রেগা শ্রমিকদেরও কৃষিক্ষেত্রে কাজ করতে মঞ্জুরী প্রদান। সম্ভব হলে প্রতি কানি জমি পিছু একটা নগদ অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করা। তাতে এগ্রি এন্টারপ্রিওনারশীপ-এর প্রতি বেকারদেরও নজর যাবে। রাজ্যের খাদ্য সুরক্ষায় একটা স্থিতিশীলতা আসবে। এক্ষনে এফ সি আই-র মাধ্যমে সরকার যেভাবে সুলভ মুল্যে ধান ক্রয় করছেন ঠিক একই ভাবে করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে কোপারেটিভ দপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত সামগ্রী ক্রয় করে সরকার নিজেই হোম ডেলিভারীর ব্যবস্থা বা তা বাজারজাত করতে পারেন। এতে একদিকে কৃষকরা তাদের ফসলের উচিৎ দাম পেয়ে যাবেন। একই রকম ভাবে ক্রেতারাও ন্যায্য মূল্যে বিভিন্ন কৃষি পণ্য শাক সব্জি, দানাশস্য ডোর-স্টেপে পেয়ে যাবেন। আমি নিশ্চিত রাজ্যে কৃষি দপ্তরের ফাঁকিবাজ একাংশ আধিকারিকরা আমার এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। কারন এতসব করতে গেলে তাদের আরও বেশি করে ক্ষেতে খামারে পরে থাকতে হবে।
২) শুধু রেগার জব কার্ড হোল্ডারদের জমিতেই এমজিএন রেগায় এক্ষনে সরকারী অর্থে পুকুর খননের মঞ্জুরী দেওয়া হয়। এই নিয়ম বদল করে জোত জমি থাকলে যে চাইবে তার জমিতেই রেগা প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে পুকুর খনন করে দেওয়া হোক। এর ফলে রাজ্যের নিজস্ব মাছের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হবে। পাশাপাশি এসব পুকুর বা জলাশয়ে বৃষ্টির জলের সংরক্ষনের সাথে সাথে ভবিষ্যত দিনে বিশ্ব জুড়ে যে পানীয় জলের মহা সঙ্কট ধেয়ে আসছে তার থেকেও খানিকটা হলেও পরিত্রান পাওয়া যেতে পারে।
৩) ত্রিপুরার নয়া সরকার-এর মুখ্যমন্ত্রী বেকারদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে পর্যটনকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু পর্যটন শিল্পের প্রসার হবে এমন কোন আকর্ষণীয় নীতি বা উদ্যোগ এখনো গ্রহন করতে পারেনি। নয়া ট্যুরিজম পলিসির নামে যা যা করার কথা বলা হয়েছে তাতে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই কম। একটি স্কীম ঘোষণা করে সর্বোচ্চ মাত্র পাঁচ লাখ টাকা ঋণ সহায়তার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বড়লোকদের হোটেল ব্যবসার জন্যে বিশাল অঙ্কের টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যের বেকার যুবকরা যদি নিজের জমিতে ছোটখাটু বনভিত্তিক রিসোর্ট খুলতে চান, বা জাতীয় মানের হোম স্টে-র ব্যবস্থাপনা করতে চান এমন সব ক্ষেত্রে পর্যটন নিগম কিন্তু বেকারদের উৎসাহিত করতে কোন স্কিম এখন পর্যন্ত চালু করতে পারেনি। তাই যত ভাবে, যত কথাই পর্যটন প্রসারের নামে গালগল্প করা হোক, রাজ্যের শিক্ষিত বেকাররা যে এই সেক্টরেও খুব বেশী স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ আপাতত দেখছেননা তা বলাই বাহুল্য। তাই করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে এমন কিছু সুযোগ সুবিধার কথা পর্যটন দপ্তরকে ঘোষণা করতে হবে যার মাধ্যমে শিক্ষিত বেকাররা যে যা চাইবেন, যেভাবে চাইনে যাতে সেইভাবেই পর্যটন বা অন্য ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ব্যাঙ্কের মার প্যাঁচ যাতে খুব বেশী না থাকে, প্রশাসনকে শুধু সেইদিকে নজর রাখতে হবে।
৪) ত্রিপুরার নয়া সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নিজেও দেখছি কথায় কথায় রাজ্যে আইটি পার্ক, বিপিও, সফটওয়্যার টেকনোলোজি পার্ক ইত্যাদির কথা বলেন। তার আশপাশের কিছু তথাকথিত আইটি বিশেষজ্ঞ এতে তালি বাজান। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ একবারের জন্যেও এই কথাটি বলেননি যে ত্রিপুরাতে ইতিমধ্যেই যে দু’টি আইটি কিংবা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ইন্দ্রননগরে ও লিচুবাগান বিপনী বিতানের উপরতলায় রয়েছে সেগুলির কি বেহাল দশা। যেখানে ইতিমধ্যেই চালু দুটি এসটিপিআই ও ইন্দ্রনগরের আইটি পার্কে কোন কোম্পানী নেই, ব্যবসা নেই, কাজ নেই, সেইক্ষেত্রে পুরানো জেলখানাকে ভেঙ্গে সেখানে তৃতীয় আইটি পার্ক-এর কি মানে থাকতে পারে? আর বিপিও ইন্ডাস্ট্রি? এব্যবসায় আজ বিশ্বজুড়েই মন্দা। আর এনিয়ে তো এরাজ্যের সম্ভাবনার বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কিন্তু এসব সহজ সত্য গুলি বিগত বাম জমানায়ও কেউ তৎকালীন মন্ত্রীদের বোঝাতে পারেননি। আর একই লোকগুলি বর্তমান জমানায়ও একই রকমভাবে বিপথে চালিত করছেন নয়া সরকারের একাংশ অনভিজ্ঞ মন্ত্রীদের।
অথচ একবারের জন্যেও এরাজ্যের তথাকথিত আইটি বিশেষজ্ঞরা এটা ভেবে দেখেননি প্রকৃত অর্থেই আই টি ক্ষেত্রে কি কি সার্ভিসেস এরাজ্যের মানুষকে বহিঃ রাজ্য থেকে আমদানি বা নিয়ে আসতে হয়। উচিৎ ছিল সেই ব্যাপারে স্টাডি করে সেই সার্ভিসেস গুলির জন্যে এরাজ্যের বুকে কোম্পানি তৈরি করা। কিন্তু প্রথম থেকেই এরাজ্যের তথাকথিত সরকারী বেতনভুক্ত একাংশ দাপুটে আইটি বিশেষজ্ঞদের একটিই ধান্দা কীভাবে বহিঃরাজ্যের কোম্পানীকে ডেকে এনে পর্তা করে নিজেদের কামাই বাড়ানো যায়। যে কারনে রাজ্য স্তরে কোন আইটি কোম্পানী গত ২৫ বছরেও এরাজ্যে গড়ে উঠেনি। যাও এক দুটি কোম্পানী মাথা চারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তাদেরকে পথে বসানোর জন্য যা যা করতে হবে তথাকথিত দাপুটে আই টি পরামর্শদাতারা এটাই করে গেছেন। সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এমন সব কাজের জন্যেও বহিঃরাজ্যের কোম্পানীকে ডেকে আনা হয়েছে যে কাজগুলি আইটি সেক্টরের স্থানীয় বেকাররাই করতে পারতো। কিন্তু টেন্ডারেই বহু ক্ষেত্রে তাদের অংশ গ্রহন করতে দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে অবাক করার কথা হল ভিন রাজ্যের কোম্পানির সাথে স্থানীয় আইটি ফার্ম গুলি যাতে যৌথ ভাবে দরপত্র জমা দিতে না পারেন তাঁর জন্যে টেন্ডারেই বলে্ রাখা হত "কনসোর্শিয়াম নট এলাউড”। আর এই সিলশিলা এখনো জারী রয়েছে। উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে গত ২৫ বছর এরাজ্য থেকে কীভাবে শত শত বেকার যুবক যুবতী পুনে, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, দিল্লী, কলকাতা, হায়দ্রাবাদে চলে গিয়েছেন করোনা মহামারীর কারনে এটা আজ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। অথচ এই রাজ্যের ছেলে মেয়েদের মেধা কম বলে অপবাদ দেওয়া হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে পূর্বতন বাম সরকার যেমন বাস্তবমুখী কোন নীতি বা স্কীম তৈরি করে এগুতে পারেননি তেমনি, বর্তমান বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারও যেন অনেকেটাই একই পথে এগুচ্ছেন। সব আমলেই চেষ্টা একটাই তথ্যের জাগলারী করে কীভাবে বেকারদের ঠকানো যায়। তাই করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পের সুবিধা গুলিকে কাজে লাগিয়ে ‘ভোকাল ফর লোক্যাল’ ধ্বনিকে মান্যতা দিয়ে রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে কীভাবে আরও বেশী করে বেকারদের জন্যে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তার জন্যে এখন থেকেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। (ত্রিপুরাইনফো ডট কম)