বাসু চ্যাটার্জি: বর্ণময় আখ্যানের রূপকার

সেবিকা ধর

সেলুলয়েডের পর্দায় ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বপ্ন আর আশার বর্ণময় আখ্যানের সার্থক রূপকার বাসু চ্যাটার্জির প্রয়াণে অবসান হল একটি যুগের - এই কথাটাই যথেষ্ট নয়। সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্বকে উন্মোচন করাই ছিল বাসু চ্যাটার্জির বিশেষত্ব। সেলুলয়েডের পর্দায় মানব মনের জটিল অথচ বর্ণিল এই চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে বদলে দিয়েছিলেন ফিল্মের পরিভাষা। তার প্রয়াণে তাই শুধু একটি যুগের অবসান হলো না - অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ’ এর।

জীবনের স্পর্শময় মধ্যপন্থার ভাবধারায় বিশ্বাসী বাসু চ্যাটার্জি হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক সিনেমার প্রবল আধিপত্যের মাঝেও আপোষ না করে তিনি বানিয়ে গিয়েছিলেন শিল্প সুষমান্বিত ফিল্ম। সারা আকাশ (১৯৬৯) দিয়ে যে যাত্রাপথের শুরু তার শেষতম মাইল ফলক ছিল কমলা কি মৌত (১৯৮৯)। তার মাঝে রয়ে গিয়েছে তাঁর আরও নির্দেশিত কালজয়ী উজ্জ্বল কত ফিল্ম ! প্রতিটি ফিল্মেই ভাস্বর হয়ে উঠে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের সুখদুঃখের অনুপম চিত্রকথা। বিষণ্ণতাকে ছাপিয়ে উঠে বেঁচে থাকার হর্ষ নিনাদিত সংগীত। স্বপ্ন দেখায় ফের নতুন আর একটি সতেজ দিনের। এতে অনুপস্থিত গ্লিসারিন ময় বাণিজ্যিক সিনেমার কল্প জগৎ। নেই কোথাও অতি নাটকীয়তার আখ্যান।

ঋষিকেশ মুখার্জি এবং বাসু ভট্টাচার্যের সমসাময়িক বাসু চ্যাটার্জির কালোত্তীর্ণ ছোটি সি বাত, রজনীগন্ধা, বাতোঁ বাতোঁ মেঁ, শৌকিন, খাট্টা মিঠা, চিতচোর, পিয়া কা ঘর, চামেলি কা শাদি’র মতো সেইসব ফিল্ম যেন আসলে এ দেশের অগণিত জন মানসেরই অন্যতম অভিব্যক্তির রূপোলী বহিঃপ্রকাশ ! দীওয়ারের রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চন যখন একাই গুদামঘরের ভেতর তোল্লাবাজি করিয়ে এক দল গুন্ডাকে মেরে শুইয়ে দেন – তা প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধে ধ্বস্ত সুপ্ত মধ্যবিত্ত-মানসিকতাকে উৎফুল্ল করে তোলে ঠিকই। কিন্তু রাগী যুবকের ইমেজ তবু স্বপ্নের মধ্যেই থেকে যায়। বরং বাসু চ্যাটার্জির আর এক অন্যতম ফিল্ম মঞ্জিল’ এর প্রেমিক অমিতাভ বচ্চন সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠে !

সত্তর দশকে ভারতীয় মূল স্রোতের সিনেমার অবিসম্বাদিত নায়ক অমিতা ভবচ্চন রাগী যুবকের চরিত্রায়নের পাশাপাশি প্রেমিকের ভূমিকাতেও যে সমান দক্ষতায় অবতীর্ণ হয়েছেন - সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অমিতাভ বচ্চনের রাগী যুবকের ‘’পারসোনা’’ গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন লেখক দ্বয় সেলিম জাভেদ এবং পরিচালক যশচোপড়া ! সেই একই সময় কিন্তু আপামর দর্শকের কাছে প্রেমিক অমিতাভ বচ্চনকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন বাসু চ্যাটার্জির মতো পরিচালকই। মঞ্জিল সিনেমার সেই বিখ্যাত গানটির কথা কি কখনও ভোলা সম্ভব। ‘’রিমঝিম গিরে শাওন’’ এর সেই মায়াবী বৃষ্টির দিন। ভেজা শাড়িতে মৌসুমী। কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের পরনে কমপ্লিট স্যুট। গলায় বাঁধা সাদা কালো স্ট্রাইপড টাই। স্বপ্ননগরীতে নেমে আসা এক তুমুল বর্ষার দিনে বৃষ্টিতে ভিজবে জেনেও কেন স্যুটেড বুটেড অমিতাভকে তাঁর প্রেমিকা মৌসুমীর সঙ্গে পথে নামিয়েছিলেন তিনি ; অন্য কোনও ক্যাজুয়েল ড্রেস নয় কেন - সেটা যে যার মতো করে ভেবে নিতে পারেন। ......‘মঞ্জিল’ এর সেই গান যে আজ ভারতীয় আইকনিক সিনেমাগুলির একটি অন্যতম দৃশ্যপট এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আর এমন সব দৃশ্যায়নের সঙ্গেই একাত্মবোধ হতে দর্শকদের বেশি সময় লাগে না। রাজেশ খান্নার রোম্যান্টিক যুগ-অবসানের পর রাগী অমিতাভের দ্রোহ ছিল সমাজে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে । তাঁর রাগ ছিল সিস্টেমের বিরুদ্ধে। এ ছিল যেন এক প্রেমহীনতার অধ্যায় ! সত্তর দশকের সেই উত্তাল রাজনৈতিক সময়ের এক মূর্ত প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এই প্রতিবাদের ভাষায় উজ্জীবিত হয়েছিল ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কিন্তু মধ্যবিত্তেরা শুধু কী রাগ করতেই জানে ? প্রেম নেই তাদের মনে ? মধ্যবিত্তের এই সংবেদনশীলতাকেই ঠিক ধরতে পেরেছিলেন বাসু চ্যাটার্জি। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। অতি সাধারণ চেহারার অমল পালেকর’কে মিষ্টি প্রেমের ছবির নায়ক বানিয়ে মধ্যবিত্তকে যেন প্রশ্বাস নেওয়ার সুবিধে করে দিয়েছিলেন। যশ চোপড়ার অমিতাভ যদি পাড়ার সেই রাগী গরম যুবক হন যেঁ নিজের জানমানের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল গুন্ডার ওপর - তখন বাসু চ্যাটার্জির নরম যুবক অমল পালেকর তাঁর প্রেয়সী বিদ্যা সিনহাকে হৃদয়ের কথা মন খুলে বলতে সাহস পান না। এই নায়ক বাসে চড়ে অফিসে যান। অফিসে বসের কথায় করতে হয় উঠবোস। ধূর্ত সহকর্মীর হাতে নাস্তানাবুদ হতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রেমে পড়ে দ্বিতীয় নারীর ! ভারতীয় মধ্যবিত্ত পুরুষের এমন দ্বৈত সত্তার কথা কী কারোর অজানা ! রাগী যুবকের বিদ্রোহের আখ্যানের পাশেই বাসু চ্যাটার্জি তখন অমল পালেকরকে নায়ক বানিয়ে নির্মাণ করেছেন রজনীগন্ধা (১৯৭৪), ছোটি সি বাত (১৯৭৬), চিতচোর (১৯৭৬), বাতোঁ বাতোঁ মেঁ’র মতো ধ্রুপদী সব ফিল্ম।

তবে বাসু চ্যাটার্জি শুধু সফট রোমেডি সিনেমার নির্মাতা নন; রাজেন্দ্র যাদবের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘সারা আকাশ’ সিনেমায় তুলে ধরেছিলেন যৌথ পরিবারের জটিলতায় সংক্ষুব্ধ বৈবাহিক সম্পর্কের কথা। অনিল কাপুর এবং অমৃতা সিং অভিনীত ‘চামেলি কি শাদি’ সিনেমায় সুক্ষ কমেডির মাধ্যমে উচ্চারিত হয় শ্রেণী এবং জাতপাত ভিত্তিক সামাজিক বিভাজনে রকথা। পঙ্কজ কাপুর, সুপ্রিয়া পাঠক, রূপা গাঙ্গুলি এবং ইরফান খান ( তাঁর প্রথম দিককার ছবি গুলির একটি ) অভিনীত ‘’কমলা কী মৌত’’ সিনেমায় প্রাক বিবাহ যৌনতা নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভন্ডামী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বাসু চ্যাটার্জি।

কিন্তু আপামর ভারতীয় মননে সব চেয়ে চর্চিত নিঃসন্দেহে তাঁর কমেডি মেশা সেই সফট রোম্যান্টিক ফিল্মগুলিই। তিনি জানতেন যাবতীয় প্রতিকুলতা সত্বেও জীবনকে প্রতি মুহূর্তে কীভাবে উপভোগ করা যায়। বৈচিত্র্যহীন মধ্যবিত্ত জীবনও তখন মজাদার হয়ে উঠে ছোটি ছোটি সিবাত’এ ! একাকী উদাস সময়ে আপন খেয়ালেই আমরা আজও অনেকেই গেয়ে উঠি, ‘’না জানে কিউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগি কে সাথ / অচানক ইয়ে মন কিসি কে জানে কে বাদ / করে ফির উসকি ইয়াদ, ছোটি ছোটি সি বাত।‘’ .........


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.