৮ জুন হোক আমাদের সম্প্রীতি দিবস

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

৮ জুন ত্রিপুরার একটি অশুভ দিন! কলঙ্কিত মানবিকতার দিন! ১৯৮০'র ৮ জুন পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরায় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। মানুষের রক্তে ভিজে গিয়েছিল ত্রিপুরার সবুজ উপত্যকা। বদলে গিয়েছিল রাজ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। শুরু হয়ে গিয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। যার জের চলেছিল পরবর্তী দীর্ঘ আড়াই দশকেরও বেশি। এই ট্র্যাজেডি বদলে দিয়েছিল আমার মতো কবি সাহিত্যিকের চিন্তাভাবনার অভিমুখ। বিক্ষত মননে শুরু হয়েছিল অন্তর্দর্শন। বারবার তারপর মানবিকতার কাছে নতজানু প্রার্থনা শুধু একটাই রয়ে যায় - ফের যেন ফিরে না আসে সেই জুন, আশির দাঙ্গা ! ২০১৮'এর জুনের প্রথম সপ্তাহে আমি ফেসবুকের মতো গণমাধ্যমে পর পর বেশ কয়েকটি পোস্ট দিয়েছিলাম। রাজ্যের কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেছিলাম, "ইতিহাস বিস্মৃতি ভালো নয়। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতি বছর ৮ জুন'কে সম্প্রীতি দিবস হিসেবে পালন করি।" কেউ সাড়া দেয় নি সেবার। কেউ না।

বড় অদ্ভুত বড় অস্বস্তিকর এই হিম শীতল হিরণ্ময় নীরবতা। ইতিহাসের প্রতি এমন নিদারুণ নির্মোহতা এমন চরম নিঃস্পৃহতার মানে কি? ইতিহাস বিস্মরণ কী আসলে ম্যানিপুলেশনের নামান্তর নয়? ......দুঃখ লাগে আমার এই অভাগিনী ত্রিপুরি মায়ের জন্য। হ্যাঁ আমার মা আমার জন্মভুমি এই পার্বতী মা সত্যই অভাগিনী। এই অভাগিনী মায়ের বহু পুত্রকন্যা আজও বহিঃরাজ্যে অথবা বিদেশে গিয়ে ত্রিপুরার সন্তান বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। পরিচয় দিতে গিয়ে বলে ওয়েস্ট বেঙ্গলে বাড়ি ! " বাংলা আমার মা " বলে থরো থরো আবেগে কবিতা লিখে ফেলে। জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি পাওয়া সত্বেও অনেকে অবসরের পর ঘর বাঁধেন কলকাতার মতো মহানগরে। গোটা জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন হয় তখন পার্বতী মায়ের সঙ্গে।

রাজ্যে বাংলা উপন্যাসের নামে রচিত হয় অত্যন্ত ইনডিভিজ্যুয়্যালিস্টিক আখ্যান। সৃজনশীল সন্তান বিস্মৃত হয় জন্মভুমির কথা; তার আপন মায়ের কথা। বিস্মৃত হয় তার মা'র গর্ভে রয়েছে ককবরকভাষী সহোদরও। মায়ের গন্ধের সঙ্গে আইডেন্টিফিকেশন তবু হয় না। হয় না। আগুনের অক্ষরে উৎসের সন্ধান চলে অন্যত্র। লিখিত হয় বধ্যভূমি মান্দাইয়ের কথা। বিস্মৃতির ওপারে চলে যায় আশির জুনের দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মহারাণী, চাচুবাজার, বোরাখার স্তোত্র। কে বলবে অন্য আর এক আপন ভাইয়ের কথা। ধর্ষিতা বোনের কথা। একপেশে দৃষ্টিতে হারিয়ে যায় ত্রিপুরার অরণ্য অভন্তরে কত বিষাদ! কে রাখে তার খোঁজ।

অসংবেদনশীল আধিপত্যবাদী মননে পার্বতী মায়ের কোনও স্থান নেই। আঁধারে গাঢ়তর হয় দুঃখের ফলকনামা। বিচ্ছেদের চিহ্নগুলি এইভাবেই বেড়ে চলে। বেড়ে উঠে আশির পরবর্তী এক মারমুখি ত্রিপুরি প্রজন্ম - যাদের মননে রয়েছে অপরিসীম ঘৃণা আর ঘৃণা। ওরা আজ গণহারে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। বিস্মৃত হচ্ছে ওরাও নিজেদের সংস্কৃতি। এর ফলে আগামী দিনে ত্রিপুরি সংস্কৃতি সমূলে বিনাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় অবশ্যই। ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতি সম্ভূত সমাজের এই বিষাদ কথন কী জানে শহুরে মানসিকতা? কখনও বোঝার চেষ্টা করে? মাঝখানে আমি স্বজাতির গাল খেয়ে মরি। "শঙ্খশুভ্র ত্রিপুরি জাতির কলঙ্ক" বলে উচ্চকিত হয় ওরা। ত্রিপুরা কেন বিভাজনের দেশ হবে? ত্রিপুরা তো প্রেমের দেশ। সাশ্রয়ের দেশ। ভালোবাসার স্বপ্নরাজ্য ! এমন স্বপ্নরাজ্যের বিভাজনও সম্ভব? না , আমি চাই না ত্রিপুরা বিভাজিত হোক । আমি চাই না ত্রিপুরা ভেঙ্গে আর একটি তিপ্রাল্যান্ড হোক। চাই অখণ্ড ত্রিপুরার সুখ শান্তি সমৃদ্ধি। চাই সম্প্রীতিময় অবিভাজিত অখণ্ড ত্রিপুরা। ইতিহাস বিস্মরণ ভালো নয়। ম্যানিপুলেশনের সম্ভাবনা রয়ে যায়। আশির জুনকে তাই বিস্মরণ না করে আসুন সবাই মিলে মাতৃবন্দনা করি, ভালবাসার কথা বলি, সম্প্রীতি দিবস হিসেবে পালন করি।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.