এ কেমন আত্মনির্ভর ভারত? পেটে ভাত নেই, বলা হচ্ছে ঋণ নিন
তাপস দে
১২ মে ২০২০, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন করোনা মহামারি এবং মানুষের দুর্ভোগ মোকাবিলায় ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। ১৩ থেকে ১৭ মে ২০২০ ধাপে ধাপে এই প্যাকেজের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। পাঁচ দিন সমানে ঘোষিত প্যাকেজের সার কথা হল আপনি যে পেশাতেই থাকুন ঋণ নিন এবং আপনার কৃষি কিংবা রুগ্ন শিল্প ইউনিট-এর সমস্যার সমাধান করে নিন। প্রধানমন্ত্রী এর নাম দিলেন আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্প। আর এই প্রকল্পের ঘোষণা করলেন কখন? যখন গোটা দেশের মানুষ ভাতের চিন্তায় পাগল প্রায়। কর্মহীন লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরতে রাস্তায়। শতাধিক লোক পথেই মারা গেলেন। তাই একটি দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল গুলিই প্রশ্ন তুললেন এটা কেমন আত্মনির্ভর ভারত গড়ার পথ? ঋণদান কীভাবে কর্মহীন, ক্ষুদার্থ মানুষের সমস্যার সমাধান হতে পারে? এর আগেও বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সাইনিং ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি নানাহ শ্লোগান দিয়েছিল। আর তার ফল কি হয়েছিল আজ তাও আমাদের সবার চোখের সামনে। কিন্তু এরাজ্যের ৩৭ লক্ষ মানুষ যে বিষয়টি সবার আগে জানতে চাইছেন অর্থাৎ আখেরে এই প্রকল্প থেকে ত্রিপুরার মানুষ কতটা লাভবান হবেন এবং কিভাবে এ সম্পর্কে কিছুই স্পস্ট নয়। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী গত ২২ মে ২০২০ সাংবাদিক সন্মেলন করে এই প্রকল্প থেকে ত্রিপুরার মানুষ ৪৮০২ কোটি টাকা সাহায্য পাবেন বলে যা যা বলার চেষ্টা করেছেন তাতে বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গেছে। সেদিনের সাংবাদিক সন্মেলনেও যে বিষয়টি বলা হয়নি এবং অত্যন্ত কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তা হল - এটা আলাদা করে বা নতুন করে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবেলায় ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে টাকা খরচ হয়েছে এবং পরে যা খরচ হবে, সবটা মিলিয়ে ২০ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ঘোষিত ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজটা এই হিসাবে ধরা আছে। এমনকি ইতিপূর্বে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র তরফে অ্যাডিশনাল লিক্যুইডিটি ব্যবস্থার প্রায় ৫ থেকে ৬ লক্ষ কোটি টাকাও রয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, ৪০ শতাংশ টাকা ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। বাকি আছে মোটামুটি ১২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। যার ৫০% টাকাই ঋণ হিসাবে দেওয়া হবে। এবং বাকি ৩০% টাকাই খরচ হবে শিল্পে ও কৃষি উৎপাদন যারা মজুত ও বাজারজাত করবেন তাদের জন্যে। এবং বাদবাকি ২০% টাকা রাখা হয়েছে দীর্ঘ মেয়াদি কিছু শিল্প পরিকাঠামো নির্মাণ ও বিত্তবান পুঁজিপতিদের ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে বা তাদের ব্যাবসা বাড়ানোর জন্যে। পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক বা গরিব মানুষ যাদের পেটে খাওয়ার নেই তাদের কথা খুবই কম ভাবা হয়েছে এই প্যাকেজে। এমনকি কৃষি ও কৃষকদের সার, বীজ, সেচ, কীটনাশক কিছুই ফ্রিতে দেওয়া হবেনা। ৫০% সাবসিডি পাবেন তারা যারা কৃষকদের এসব সামগ্রি বিক্রি করবেন। আর যারা অতি ক্ষুদ্র শিল্প সেক্টরে (এম এস এম ই) আছেন তাদেরকেও শিল্প ইউনিট বাঁচাতে হবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ঋণ হিসাবে নিয়ে। সরকার এম এস এম ই-এর মত রুগ্ন শিল্প বাঁচাতেও কোন আর্থিক সাহায্য দেবেনা। করোনা মহামারী মোকাবেলারা নামে ঘোষিত এই প্যাকেজের প্রতিটি ছন্দে শুধু ঢালাও বেসরকারিকরনের কথা। রাস্ট্রয়াত্ত ক্ষেত্রকেও সীমাবদ্ধ করা হয়েছে শুধু তথাকথিত ‘স্ট্র্যাটেজিক’ ক্ষেত্রে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রই উন্মুক্ত হয়ে গেল বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য।
ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (এম এস এম ই) ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে সরাসরি কোনও আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা না দিয়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করে এই ক্ষেত্রকে ঋণ দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ১৩ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘এই ছোট সংস্থা গুলি চার বছরের জন্য ঋণ নিতে পারবেন। তার জন্য কোন রকম বন্ধক বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি জমা দিতে হবে না। ব্যাঙ্ক গ্যারান্টার হবে সরকার। তার মধ্যে প্রথম এক বছর ঋণের সুদ বা কিস্তি দিতে হবে না।’ অর্থাৎ শিল্পকে বাঁচাতে ঋণই ভরসা। এম এস এম ই-গুলি শুধু ইপিএফ এবং টিডিএস-এ ছাড় পাবে। তবে রিয়েল এস্টেট সংস্থা, ঠিকাদারদের জন্য ভাল সুবিধার ঘোষণা রয়েছে। যদিও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, ছোট ও মাঝারি শিল্পের। কিন্তু তাদের জন্যে আর্থিক প্যাকেজে সরাসরি কিছুই দেওয়া হলনা। বলা হল ঋণ নিতে।
এমনকি এনপিএ (আনাদায়ী ঋণ)- এর চাপে কাবু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট গুলিকেও ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়েই তাদের শিল্প ইউনিটকে বাঁচাতে হবে। সরাসরি কোনও সাহায্য নেই। এই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হবে। ঋণগ্রস্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসা বাড়াতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে সব ধাপ্পাবাজির মধ্যেও যে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটি হল- এবার থেকে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে ২০০ কোটি পর্যন্ত গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হবে না। প্রধানমন্ত্রী এলক্ষ্যে লোকালদের জন্যে ভোকাল হওয়ার’ কথা বলেছেন। অর্থাৎ দেশীয় সংস্থা গুলির কাজের ক্ষেত্র এর ফলে প্রসারিত হবে। একই সাথে স্থানীয় প্রোডাক্টকে বাঁচাতে স্থানীয়ভাবে তার ব্যাবহার বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। যদিও এম এস এম ই-র গাইডলাইন ও ত্রিপুরার শিল্প নীতিতেও লোকালদের জন্যে নানাহ সব সুবিধা স্থানীয় শিল্প সংস্থাগুলিকে দেওয়ার কথা আগে থেকেই বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার মত রাজ্যে সরকারী প্রশাসনই তা উল্লোঙ্ঘন করছে। স্থানীয়দের বঞ্ছিত করে বাইরের কোম্পানিকে ডেকে এনে সরকারি সব কাজ বিলানো হয়েছে ও হচ্ছে। অথচ ১৩ মে ২০২০ থেকে শুরু করে ১৭ মে ২০২০ টানা পাঁচ দিন ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর ভারত গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছেন, তার উপকরণগুলি বিশদে ব্যাখ্যা করার সময়ও একাধিকবার লোকালদের জন্যে ভোকাল হওয়ার কথা্ বলেছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরাতে হচ্ছে তার উল্টো। প্রতিটি সরকারি কাজের জন্যে এমন ভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে স্থানীয়রা টেন্ডারেই অংশ নিতে পারছেনা।
আর সবচেয়ে বড় কথা হল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা বিজেপি-র প্রদেশ সভাপতি এই কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে যতই প্রচার করুন, এটা বুঝতে হবে যে এই প্যাকেজ থেকে রাজ্যের মানুষ কি পাবে এবং কিভাবে পাবেন। কথায় কথায় লক্ষ কোটি-র প্যাকেজের কথা শুনানোর চেয়ে সত্য কথাটি সহজভাবে লোকের সামনে উপস্থাপন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অন্যথায় ২০১৮ এর ভিসন ডকুমেন্ট এর মতো পরে পস্তাতে হবে। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে সরকারি কোষাগারের লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের সুমুখশ্রির বানি প্রচারে ব্যস্ত বিপ্লব দেব মহাশয় প্রায় প্রতিদিনই যেটা এই মুহূর্তে কোনও ভাবেই করা যাবেনা সেটাও প্রতিশ্রুতি প্রদানের নামে বলে বেড়াচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী গত ২২ মে ২০২০ সাংবাদিক সন্মেলন করেও করোনা প্যাকেজ থেকে ত্রিপুরার মানুষ ৪৮০২ কোটি টাকা সাহায্য পাবেন বলে দাবী করেছেন। প্রতিশ্রুতি-র নামে মুখ্যমন্ত্রী যা যা বলার চেষ্টা করেছেন তাতে বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গেছে। নীচের সারণীটির দিকে একবার কষ্ট করে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে ২০ লাখ কোটি – র প্যাকেজ থেকে ত্রিপুরার মত রাজ্যের মানুষ বাস্তবে কি পাবেনঃ
Sl No প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন
1 .করোনা মহামারী মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার আত্মনির্ভর ভারত আর্থিক প্যাকেজ ১২ মে ২০২০, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন করোনা মহামারি এবং মানুষের দুর্ভোগ মোকাবিলায় ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এরাজ্যের ৩৭ লক্ষ মানুষ যে বিষয়টি সবার আগে জানতে চাইছেন অর্থাৎ আখেরে এই প্রকল্প থেকে ত্রিপুরার মানুষ কতটা লাভবান হবেন এবং কিভাবে এ সম্পর্কে কিছুই স্পস্ট নয়। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী গত ২২ মে ২০২০ সাংবাদিক সন্মেলন করে এই প্রকল্প থেকে ত্রিপুরার মানুষ ৪৮০২ কোটি টাকা সাহায্য পাবেন বলে যা যা বলার চেষ্টা করেছেন তাতে বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গেছে। সেদিনের সাংবাদিক সন্মেলনেও যে বিষয়টি বলা হয়নি এবং অত্যন্ত কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা হল - এটা আলাদা করে বা নতুন করে ২০ লক্ষ কোটি টাকার কোনও প্যাকেজ নয়। বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবেলায় ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে টাকা খরচ হয়েছে এবং পরে যা খরচ হবে, সবটা মিলিয়ে ২০ লক্ষ কোটি টাকা। আর মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরা সরকার এই প্যাকেজ থেকে ৪৮০২ কোটি পাবেন বলে যে গল্প ফেঁদেছেন আসলে তাতে সরাসরি প্রাপ্তি খুবই কম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ চাইলে ঋণ নিতে পারবেন।
2 .এমজিএনরেগার মাধ্যমে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন গ্রামীন জনতা ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এমজিএন রেগা প্রকল্পে ৪০০০০ হাজার কোটি টাকার একটি আতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা সরকার এই বরাদ্দ থেকে ১৬০ কোটি টাকা পাবে বলে মুখ্যমন্ত্রী ২২ মে, ২০২০ সচিবালয়ে সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন। এই টাকা থেকে ১৫০০০ পরিযায়ী শ্রমিককেও ৫০ দিন রেগার কাজ দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল পরিযায়ী শ্রমিকদের রেগার কাজ কীভাবে দেবেন? তাদের তো জব কার্ডও নেই। তাছাড়া, বর্তমানে গ্রামে যারা রেগার জবকার্ড হোল্ডার রয়েছেন তারাই তো বহু ক্ষেত্রে রেগার কাজ পাচ্ছেনা। এক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেই একশ দিনের কাজ প্রকল্পে তারাও যোগ দিতে পারবেন- এসব ঢপবাজি লকডাউনের কঠিন সময়েও কি না করলেই নয়? কেননা, ত্রিপুরার বহু পাহাড়ি গ্রাম থেকে খবর আসছে, আভাবের তাড়নায় গরীব মানুষ রেশন কার্ডটি পর্যন্ত বন্ধক দিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ প্রশাসন কিছুই করছেন না।
3. ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান রেশন কার্ড’ ও ‘আগামী দু’মাস বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড প্রকল্পে দেশের যে কোন প্রান্তে খাদ্যসামগ্রী সরকারি গনবন্টন অর্থাৎ রেশন দোকান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন যেকোনো রেশন কার্ড হোল্ডার এমনকি পরিযায়ী শ্রমিকরাও। প্রায় ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য এই প্রকল্পে ৩৫০০ কোটি খরচ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু বাস্তবে ‘রেশন কার্ড ডিজিটাইজেশনের কাজই শেষ হয়নি। এখনও চলছে রাজ্যে রাজ্যে। সেই কাজ আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যেও শেষ হবে কিনা সন্দেহ। বলা হচ্ছে, ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান রেশন কার্ড’ নামে এই প্রকল্পে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে রেশন তুলতে পারবেন উপভোক্তারা’। কিন্তু লকডাউনের এই কঠিন সময়ে গরিব মানুষের পেটে যখন খাবার প্রদান সবার আগে প্রয়োজন ছিল তখন ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড প্রকল্পের কথা শোনানোর কি যুক্তি থাকতে পারে কেউই বুঝতে পারছেন না।
তাছাড়া, ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন বলেছিলেন, ‘আগামী দু’মাস বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের। যাদের কার্ড নেই তাদেরও মাথা পিছু পাঁচ কেজি চাল বা গম ১ কেজি ছোলা দেওয়া হবে’। পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ রাজ্যে ফিরে গেলে একশ দিনের কাজ প্রকল্পেও যোগ দিতে পারবেন। এ ব্যাপারে সব রাজ্য সরকারকে নাকি পরামর্শ ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচও নাকি করে ফেলেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এখনও এই ব্যাপারে কোনও সার্কুলারই জারী করতে পারেনি।
4 .ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ৩ লক্ষ কোটি টাকার বন্ধকহীন অটোমেটিক লোন প্রদানের প্রতিশ্রুতি করোনা মহামারী প্রিস্থিতিতেও ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (এম এস এম ই) ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে সরাসরি কোনও আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা না দিয়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করে এই ক্ষেত্রকে ঋণ দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ১৩ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘এই স্কিমে ছোট সংস্থা গুলি চার বছরের জন্য ঋণ নিতে পারবেন। তার জন্য কোন রকম বন্ধক বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি জমা দিতে হবে না। ব্যাঙ্ক গ্যারান্টার হবে রাজ্য সরকার। তার মধ্যে প্রথম এক বছর ঋণের সুদ বা কিস্তি দিতে হবে না।’ অর্থাৎ শিল্পকে বাঁচাতে ঋণই ভরসা। ত্রিপুরাতে ৫০০ এমএসএমই ও ১ লক্ষ ব্যাবসায়ি প্রতিষ্ঠানকে ৯.২৫% সুদে ৩.৫০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই দুর্দিনের বাজারে চড়া হারে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে ব্যাবসা বাড়াতে বা নতুন ব্যাবসা শুরু করতে কে উদ্যোগ নেবে? কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজ্যকে ৩৫০ কোটি টাকা দিতে রাজিই থাকে তাহলে ঋণ হিসাবে কেন? সরকারের উচিত ছিল সরাসরি ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের এই টাকাটা বিনা সুদে দিয়ে সাহায্য করা।
5 .‘হকারদের ঋণ দিতে বরাদ্দ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি ‘লকডাউনের ফলে শ্রমিক কৃষকদের পরে সবচেয়ে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মুখে পরেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা। কিন্তু একথা মেনে নিয়েও ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন জানান, ক্ষুদ্র বিক্রেতা ও হকারদেরও ঋণ নিয়েই তাদের ব্যবসা চাঙ্গা করতে হবে। তাই হকারদের জন্য সরকার সহজে ঋণের ব্যবস্থা করেছে’। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ‘হকারদের ঋণ দিতে বরাদ্দ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। হকারদের ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ২ শতাংশ হারে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হবে। এর ফলে দেশে ৫০ লক্ষ হকার উপকৃত হবেন’। এছাড়া এই ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল পেমেন্ট চালু করলে ভবিষ্যতে আরও বেশি ঋণ বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাবেন। লকডাউনের এই কঠিন সময়ে গরিব ক্ষুদ্র বিক্রেতা ও হকারদেরও পেটে যখন খাবার প্রদান সবার আগে প্রয়োজন ছিল তখন তাদের জন্যে নানাহ শর্ত জুড়ে দিয়ে ঋণ প্রকল্পের গল্পের কথা শোনানোর কি যুক্তি থাকতে পারে? তাই প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষুদ্র কৃষকদের মত তাদেরও কি ঋণের জালে ফেলে ভোটের দোকানদারিটা লকডাউনের পরেও জোরদার ভাবেই চালু রাখার জন্যেই কি চেষ্টা ? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সন্মেলন করে বলেছেন ত্রিপুরার প্রায় ৯০০০ স্ট্রিট ভেন্ডার ১০০০০ টাকা করে ঋণ পাওয়ার যোগ্য। আর ছোট অনেক দোকানী এই সুযোগ পাবেন না কারণ একটা বিশাল অংশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাকি ট্রেড লাইসেন্স নেই। শুধু আগরতলা শহরেরই ২২ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মধ্যে মাত্র ৮ হাজার ব্যবসায়ীর নাকি ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। তাই এই খাতে বরাদ্দ ৫০০০ কোটি টাকা হলেও ত্রিপুরার ভাগে আসবে মাত্র ৯ কোটি। তাও এই টাকা দেওয়া হবে ঋণ হিসাবে।
6. কেসিসি-ঋণে তিন মাসের সুদ মুকুবের ঘোষণা কৃষকদের জন্যে শুধু কেসিসি-ঋণে তিন মাসের সুদ মুকুবের ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন করে দেশের আড়াই কোটি কৃষককে কিষান ক্রেডিট কার্ডের আওতায় এনে কম সুদে মোট ২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। মৎস্যচাষ ও পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরও কিষান ক্রেডিট দেওয়া হবে। গত দু’মাসে নতুন ২৫ লক্ষ কিষান ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। লকডাউনের সময়ে মৎস্যচাষ, পশুপালন ও কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যখন সার, বীজ, মাছের খাদ্য, পোনা বা পশুপালকদের নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল, তা না দিয়ে তাদেরকে ঋণ নিতে বাধ্য করে উল্টো ঋণের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে, যাতে করে ওরা যেন এবার চিরতরে ঋনের ফাঁদে পড়েন। তিন কোটি প্রান্তিক কৃষককে ইতিমধ্যেই ৪ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়ার নাম করে ঋণের ফাঁদে ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে ভোটের দোকানদারিটা লকডাউনের পরেও জোরদার ভাবেই চালু থাকে।
এ ব্যাপারে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ত্রিপুরার ১.৪২ লাখ নতুন কৃষককে কেসিসি-র আওতায় আনা হবে এবং ২% সুদে তাদের ঋণ দেবেন। যদি কৃষকরা ঋণ নিতে চায়।
7. এনবিএফসি, এইচসিএফসি এবং এমএফআই গুলির জন্য স্পেশাল লিকুইডিটি স্কিম এনবিএফসি, এইচসিএফসি এবং এমএফআই গুলির জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার স্পেশাল লিকুইডিটি স্কিম চালু করা হবে। তবে এই স্কিম থেকে ত্রিপুরার মানুষ কীভাবে উপকৃত হবেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সাংবাদিক সন্মেলনে স্পস্ট করে কিছু বলতে পারেন নি। যদিও মুখ্যমন্ত্রী দাবী করেছেন এই স্কিম থেকে ত্রিপুরার মানুষ ৯০ কোটি টাকা সাহায্য পাবেন। কীভাবে পাবেন মুখ্যমন্ত্রীই জানেন না। মুখ্যমন্ত্রী শুধু বলেছেন গ্রামগঞ্জের গরিব মানুষকে নাকি এসব এনবিএফসি, এইচসিএফসি এবং এমএফআই কোম্পানি গুলি ঋণ দেয়। সরকার এখন ব্যবসা চাঙ্গা রাখতে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করবেন, আর সরকার তাদেরকে চাপ দেবেন গ্রামের মানুষকে ঋণ দিতে। অর্থাৎ আপনি কৃষকই হোন বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীই হোন আপনাকে ঋণের ফাঁদে কীভাবে ফেলা যায় করোনাকালেও মোদীর আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে মূল অভিমুখই হল সেটা।
8 .আরও তিন মাস ধরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের ইপিএফ সাপোর্ট ১৩ মে ২০২০ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর করোনা প্যাকেজ ঘোষণার একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় ছিল ইপিএফ। এদিনের ঘোষণা অনুযায়ী, বেসরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে আগামী তিন মাস ইপিএফ বাবদ মূল বেতনের (বেশিক পে) ১০ শতাংশ টাকা কাটা হবে এবং সংস্থা গুলিও কর্মী প্রতি ১০ শতাংশ করেই এপিএফ জমা করবে। এতদিন ১২ শতাংশ করে উভয়ের থেকেই ইপিএফ বাবদ কাটা হত। কিন্তু সরকারি কর্মীদের জন্য চলতি নিয়ম অনুযায়ী ১২ শতাংশ করেই ইপিএফ বাবদ দেবে সরকার। তবে বেসরকারি কর্মীদের থেকে ১০ শতাংশ ইপিএফ কাটা হবে, যাতে তাদের হাতেও নগদের যোগান বাড়ে। এছাড়াও লিক্যুইডিটি রিলিফ দেওয়া হবে সব প্রতিষ্ঠানকে যারা ইপিএফ-এর সদস্য। জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে কর্মচারীদের এবং নিয়োগকারীদের অংশের এপিএফ-এর টাকা সরকার দিয়ে দেবে। ২৫০০ কোটি টাকা নাকি বরাদ্দ করা হয়েছে এই তহবিলে। এর আগে তিন মাসের জন্য এই সুবিধা সরকার দিয়েছে। তা আরও তিন মাস প্রসারিত করা হল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ৭২ লক্ষ কর্মচারী এর ফলে উপকৃত হবেন। আর এক্ষেত্রে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী ত্রিপুরার প্রায় ৫২ হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নাকি উপকৃত হবেন। মন্দের হলেও নিঃসন্দেহে এটা একটা ভাল সিদ্ধান্ত যদি কথা মত রূপায়ন করা হয়। কিন্তু দাবী ছিল যেহেতু উৎপাদন বন্ধ তাই লকডাউনের কয়েকটা মাসের জন্যে এম এস এম ই-র শ্রমিক কর্মচারীদের বেতনের অন্তত ৫০% সরকার মিটিয়ে দিক।এবং ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান গুলির জলের বিল, বিদ্যুতের বিল, ইন্টারনেটের বিল মুকুবেরও দাবী ছিল। কিন্তু অন্যতম এই দাবীগুলিই মানা হলনা।
9. ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত টেন্ডারের ক্ষেত্রে গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হবে না তবে সব ধাপ্পাবাজির মধ্যেও যে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটি হল- এবার থেকে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে ২০০ কোটি পর্যন্ত গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হবে না। প্রধানমন্ত্রী এলক্ষ্যে লোকালদের জন্যে ভোকাল হওয়ার’ কথা বলেছেন। অর্থাৎ দেশীয় সংস্থা গুলির কাজের ক্ষেত্র এর ফলে প্রসারিত হবে। একই সাথে স্থানীয় প্রোডাক্টকে বাঁচাতে স্থানীয়ভাবে তার ব্যাবহার বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। যদিও এমএসএমই-র গাইডলাইন ও ত্রিপুরার শিল্প নীতিতেও লোকালদের জন্যে নানাহ সব সুবিধা স্থানীয় শিল্প সংস্থা গুলিকে দেওয়ার কথা আগে থেকেই বলা আছে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার মত রাজ্যে সরকারী প্রশাসনই তা উলঙ্ঘন করছে। স্থানীয়দের বঞ্চিত করে বাইরের কোম্পানিকে ডেকে এনে সরকারি সব কাজ বিলানো হয়েছে ও হচ্ছে। অথচ ১৩ মে ২০২০ থেকে শুরু করে ১৭ মে ২০২০ টানা পাঁচ দিন ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর ভারত গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছেন, তার উপকরণগুলি বিশদে ব্যাখ্যা করার সময়ও একাধিকবার লোকালদের জন্যে ভোকাল হওয়ার কথা্ বলেছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরাতে হচ্ছে তার উল্টো। প্রতিটি সরকারি কাজের জন্যে এমন ভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে স্থানীয়রা টেন্ডারেই অংশ নিতে পারছেনা।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী ২২ মে-এর সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন, ত্রিপুরা সরকারও এখন থেকে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত সামগ্রী ক্রয়ে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু তিনি শুধু এই ব্যাপারে ম্যানুফেকচারিং সেক্টর এর কথাই বলেছেন। সার্ভিস সেক্টর এর ব্যাপারে কিছু বলেন নি। যদিও ত্রিপুরার জি ডি পি-র ৫২% ই সার্ভিস সেক্টর থেকে আসে।
10. মুদ্রা – শিশু লোনের জন্য ১,৫০০ কোটি টাকা প্রদান কৃষি ক্ষেত্রের পর লকডাউনের কারনে -মুদ্রা লোনের আওতায় আসা ছোট ব্যবসা সবচেয়ে বেশী বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ঋনগ্রস্থগণকে প্রথমে আরবিআই দ্বারা সাহায্য করা হবে বলা হয়েছিলো। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, সুদ ৩ মাস পর হলেও প্রদান করতে হবে।
দেশে মুদ্রা–শিশু লোনের বর্তমান পোর্টফলিও হচ্ছে ১.৬২ লাখ কোটি টাকা (অধিকতম ঋন রাশি ৫০,০০০ টাকা)। এমনিতেই লকডাউনের কারনে ত্রিপুরার মুদ্রা লোনীদের অবস্থা করুন। ঋণের ফাঁদে জর্জরিত ত্রিপুরার ৪৫১৯৬ মুদ্রা- শিশু লোনী। এখন তাদেরকে ২% সুদ মাফ করে নতুন করে লোন নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিল্পব কুমার দেব প্রতিটি ক্ষেত্রে লোন দেওয়ার উদ্যোগকে যেভাবে বুক ফুলিয়ে করোনা মহামারীকালে মানুষকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বলে বলার চেষ্টা করছেন, এনিয়ে স্বভাবতই সংশ্লিস্ট মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। যেখানে এধরনের রুগ্ন শিল্প উদ্যোগী ও তাদের সহকর্মীদের বাঁচাতে সরকারের প্রয়োজন ছিল ঋণ মুকুব কিংবা নতুন করে সুদহীন ভর্তুকি যুক্ত এককালিন আর্থিক সাহায্য প্রদান, সেটা না করে ফের তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলার চেষ্টাকে বাহবা দেওয়া হচ্ছে তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে আগামী দিন রাজ্যের অর্থনৈতিক দৈনতা কিরকম ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
11.এমআইজি-র আবাস ক্ষেত্রে ৭০ হাজার কোটি টাকা সহায়তা মধ্যবিত্তদের জন্য (বার্ষিক আয় ৬ থেকে ১৮ লাখ) ক্রেডিট লিংক সাবসিডি যোজনা মে ২০১৭ থেকে চালু করা হয়েছিল। এই যোজনা থেকে এখন পর্যন্ত দেশের ৩.৩২ লক্ষ পরিবার লাভান্বিত হয়েছেন। কেন্দ্র সরকার সি এল এস এস যোজনার বিস্তার মার্চ ২০২১ পর্যন্ত চালিয়ে যাবে। ত্রিপুরা সরকার এই যোজনা থেকে কতটা কি সাহায্য পাবেন মুখ্যমন্ত্রী তার সাংবাদিক সন্মেলনে স্পস্ট করে কিছুই বলেন নি।
12.কৃষকদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ইমারজেন্সি ব্যাঙ্কিং ক্যাপিটাল ফান্ডিং করোনা পরিস্থিতিতে এই বছর নাবার্ড - এর মধ্যমে ৯০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হবে সরকারী কৃষি ক্ষেত্র গুলিকে রক্ষা করতে। ৩৩টি রাজ্য সরকারের ব্যঙ্কে ও ৩৫১টি জেলায় সরকারী ব্যাংক এবং ৪৩ টি আর আর বি -কে তাদের ঋন প্রদান শর্তাবলী অনুযায়ী ফ্রন্ট লোডেড অন টেপ সুবিধা প্রদান করা হবে। কেন্দ্রের সরকারের দাবী, আনুমানিক ৩ কোটি কৃষকের মধ্যে বেশীরভাগ ছোট ও সীমান্ত কৃষকেরা এতে লাভবান হবেন। এক্ষেত্রে ত্রিপুরা গ্রামীন ব্যাঙ্ক ও ত্রিপুরা স্টেট কোপারেটিভ ব্যাঙ্ক এর মাধ্যমে নাবার্ড এর সহযোগিতায় ২.৫% সুদে ত্রিপুরার কৃষকদের ৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ সহায়তা করা যাবে, যদি কৃষকরা ঋণ নিতে রাজি হন। যদিও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ি, ছোট ও মাঝারি শিল্পের। কিন্তু তাদের জন্যে আর্থিক প্যাকেজে সরাসরি কিছুই দেওয়া হলনা। কৃষকদেরও বলা হচ্ছে ঋণ নিতে। ৩০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ইমারজেন্সি ব্যাঙ্কিং ক্যাপিটাল ফান্ডিং কৃষকদের জন্য দেওয়ার কথা বলে বাস্থবে তাদেরকে ঋণ নিতে বলা হল।
13. ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে ৩ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের জেরে কৃষি ক্ষেত্রের পরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের। এই ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে ৩ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগীদের ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ছোট সংস্থা গুলি চার বছরের জন্য ঋণ নিতে পারবেন। তার জন্য কোনরকম বন্ধক বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি জমা দিতে হবে না। ব্যাঙ্ক গ্যারান্টার হবে সরকার। এই ঋণ দেওয়া হবে চার বছরের জন্য। তার মধ্যে প্রথম এক বছর ঋণের সুদ বা কিস্তি দিতে হবে না।ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী গত ২২ তারিখ তার এক সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন ৩ লক্ষ কোটি টাকার এই কেন্দ্রীয় যোজনা থেকে ত্রিপুরা ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা ক্ষুদ্র উদ্যোগীদের দিতে পারবেন, যদি তারা ঋণ সহায়তা নিতে চান। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন ত্রিপুরার সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা স্ট্রিট ভেন্ডাররা এই স্কিমের সাহায্য ইচ্ছা থাকলেও নিতে পারবেন না কারণ অধিকাংশই নাকি ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই এটা পরিষ্কার যে রাজ্যের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এই রুগ্ন দশা সহসা মিটবে না। তবে রাজ্যের শিল্প পরিকাঠামো প্রসারে করোনা মহামারীর প্যাকেজ থেকে ত্রিপুরা সরকার সাব্রুম স্পেশাল ইকোনোমিক জোন(এসইজেড) বাবদ ১৫০ কোটি টাকা পাবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।
14.‘এনপিএ (আনাদায়ী ঋণ)- এর চাপে কাবু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেও ঋণ প্রদান ‘এনপিএ (আনাদায়ী ঋণ)- এর চাপে কাবু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলিকে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হবে বলে ১৩ মে, ২০২০ ঘোষণা দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সীতারমন। তবে বড় শিল্প সংস্থাই নয়, এনপিএ (আনাদায়ী ঋণ)- এর চাপে কাবু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট গুলিকেও ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়েই তাদের শিল্প ইউনিটকে বাঁচাতে হবে। সরাসরি কোনও সাহায্য নেই। এই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হবে। তবে ত্রিপুরা সরকার ত্রিপুরার কত এনপিএ হয়ে যাওয়া শিল্প সংস্থার মালিক এই স্কিমের সাহায্য পাবেন তা এখনও স্পস্ট নয়, কেননা কীভাবে কি শর্তের ভিত্তিতে এনপিএ হয়ে যাওয়া শিল্প সংস্থার মালিকরা এই স্কিমের সুযোগ গ্রহন করতে পারবে এ ব্যাপারে এখনও কোন সরকারি সার্কুলার ত্রিপুরাতে জারি হয়নি।
15. ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা গুলির (এমএসএমই) সংজ্ঞায় বদল ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পসংস্থা গুলির (এমএসএমই) সংজ্ঞায় বদল এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংজ্ঞা নির্ধারণে এখন বিনিয়োগকৃত পুঁজির অঙ্কের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বাৎসরিক টার্নওভারের পরিমান। এছাড়া পরিষেবা এবং উৎপাদন ক্ষেত্রের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নয়া ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এখন থেকে উৎপাদনও পরিষেবা শিল্পের সঙ্গে জড়িত যে সমস্ত সংস্থার লগ্নি ১ কোটি টাকার কম এবং টার্নওভার ৫ কোটি টাকার কম সেগুলি ক্ষুদ্র (মাইক্রো) শিল্প সংস্থা হিসেবেই বিবেচিত হবে। ছোট সংস্থা গুলির ক্ষেত্রে এই অঙ্ক বেড়ে হবে যথাক্রমে ১০ কোটি এবং ৫০ কোটি টাকা। আর যে সমস্ত সংস্থার লগ্নি ২০ কোটি টাকার কম এবং টার্নওভার ১০০ কোটি টাকার কম, কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া সংজ্ঞায় সেগুলি মাঝারি শিল্প সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত হবে। করোনা আবহে করুন দশা ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা গুলিকে বাঁচাতে যখন তাদের বন্ধ বা বন্ধ প্রায় শিল্প ইউনিটকে সরাসরি বড়সড় আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া উচিৎ ছিল তখন এম এস এম ই-র সংজ্ঞা পরিবর্তন করেই সরকার তার দায়িত্ব শেষ করলেন।অথচ, অপেক্ষাকৃত বড়লোকদের কোম্পানির মালিকদের ১৮ হাজার কোটি টাকা আয়কর রিফান্ড অর্থাৎ ফেরত দেওয়া হয়েছে। যাদের ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রিফান্ড পাওনা ছিল, তারা টাকা পেয়েও গেছেন। এতে ১৪ লক্ষ করদাতা উপকৃত হয়েছেন।’ কিন্তুএম এস এম ই গুলিকে কিছুই ছাড় দেওয়া হলো না।বলা হলো ঋন নিতে।
16.সরকার থেকে বা কোনও রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থা থেকে যদি কোনও ক্ষুদ্র, ছোট বা মাঝারি শিল্পের বকেয়া পাওনা থাকে, তা আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে মিটিয়ে দেওয়া হবে
সরকার বা কোনও আধা সরকারী বা কোনও রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থা থেকে যদি কোনও ক্ষুদ্র, ছোট বা মাঝারি শিল্প সংস্থার কোনও বিল পেন্ডিং থাকে তা আগামি ৪৫ দিনের মধ্যে মিটিয়ে দিতে বলা হয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র, ছোট বা মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে, টাকার অভাবে চালু করতে পারছেনা। অনেকে ব্যাংক লোন পরিশোধ করতে পারছেনা। কিন্তু করোনার কঠিন পরিস্থিতিতেও এসব ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগীদের বলা হচ্ছে ফের ঋণ নিয়ে ব্যাবসা শুরু করতে। অথচ, ৩০ হাজার কোটি টাকা লিক্যুইডিটি ঘোষণা করা হয়েছে হাউজিং ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স ইনস্টিটিউট গুলির জন্য। অথচ ক্ষুদ্র, ছোট বা মাঝারি শিল্পের সরকারী বকেয়াও বছরের পর বছর ধরে মেটানো হচ্ছেনা।
অবশ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিপ্লব দেব ২২ মে, ২০২০ সাংবাদিক সন্মেলনে করোনা মোকাবেলায় আত্মনির্ভর ভারত স্কিমের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন ত্রিপুরার ঠিকাদার সাপ্লায়ার বা বিভিন্ন বেসরকারি ও আধা সরকারি দপ্তরে যে বকেয়া রয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা মিটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। এবং অর্থ দপ্তরকে গত ৫-৭ বছর বা তার আগেরও কোন বকেয়া থাকলে তা খতিয়ে দেখে তা পেমেন্টের ব্যাবস্থা করতে বলা হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।
17.৩০ হাজার কোটি টাকা লিক্যুইডিটি ঘোষণা হাউজিং ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স ইনস্টিটিউট গুলির জন্য যাদের বহু লক্ষ কোটির ব্যাবসা, অর্থের সংকট দেখিয়ে, তাদের জন্য লিক্যুইডিটি সুপারেন্টেন্ট প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি রিয়েল এস্টেট সংস্থা গুলিকেও স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে লিক্যুইডিটি সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোভিডের কারনে যেহেতু কাজ বন্ধ ছিল, তাই সরকারী ঠিকাদারি কাজের টাইমলাইন ৬ মাস বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা পেটের দায়ে এখনও পথে পথে হাঁটছেন তাদের জন্যে কিছুই নেই। শুধু বলা হয়েছে ঘরে ফিরলে তারা আগামি দুই মাস ফ্রি রেশন এবং রেগার কাজ পাবে। কিন্তু দেখা গেছে ত্রিপুরা সরকার এব্যাপারেও এখনও কোন সার্কুলার জারি করেনি। বাইরে থেকে আসা এসব শ্রমিকরা কীভাবে আগামী দুই মাস ফ্রি রেশন এবং রেগার কাজ পাবেন কেউ বলতে পারছেন না। অথচ, ৩০ হাজার কোটি টাকা লিক্যুইডিটি ঘোষণা করা হয়েছে হাউজিং ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স ইনস্টিটিউট গুলির জন্য। হায়রে ভারতবর্ষ। প্যাকেজ ঘোষণা করা হল করোনা মহামারী মোকাবেলার জন্যে আর হাতে ক্ষীর তোলে দেওয়া হচ্ছে হাউজিং ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানি, মাইক্রো ফিনান্স ইনস্টিটিউট গুলির মালিকদের জন্য।
18. টিডিএস কেটে নেওয়ার হার ২৫ শতাংশ হ্রাস যারা নির্দিষ্ট বেতন কোনও সংস্থা থেকে পান, সেইসব ক্ষেত্রে উৎস মূলে (টিডিএস) কেটে নেওয়ার হার ২৫ শতাংশ কমানো হচ্ছে। চুক্তি বাবদ অর্থ, কনসালটেন্সি ফি, ডিভিডেন্ড, কমিশন, ব্রোকারেজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর ছাড়ের এই সুবিধা পাওয়া যাবে। ১৪ মে থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত এই কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে।এজন্যে নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানি গুলির জন্য ৪৫ হাজার কোটি টাকার লিক্যুইডিটির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
19.সরকারি কাজে ঠিকাদারদের কাজ শেষ করতে ৬ মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হবে সরকারি ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের কাজ শেষ করতে ৬ মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হবে। কারণ, কোভিড সঙ্কটের জন্য তারা কাজ করাতে পারেনি। নির্মাণ কাজের ঠিকাদার বা যারা সরকারকে বিভিন্ন জিনিস সরবরাহ করেন তারা এই সুবিধা পাবেন। শুধু তাই নয়, ঠিকাদাররা কোনও প্রকল্পের নির্দিষ্ট অংশের কাজ ইতিমধ্যে করে ফেললে সেই অনুপাতে ব্যাঙ্ক গ্যারান্টির টাকা তাদের ফেরত দেওয়া হবে। যাতে তাদের নগদের সংকট না হয়। ত্রিপুরাতে এব্যাপারে এখনো কোন সরকারি সার্কুলার জারী হয়নি। যদিও করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্যাকেজে এরকম কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী সীতারমন।
20. বিদ্যুৎক্ষেত্রের জন্যও ৯০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করোনা মহামারি মোকাবেলার নামে আধা সরকারী, বহুজাতিক ও বিত্তবানদের মালিকানাধীন, বিদ্যুৎক্ষেত্রের জন্যও ৯০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে। পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তথা ডিসকম গুলিকে এই ৯০ হাজার কোটি টাকা এককালিন দেওয়া হবে।বলা হয়েছিল প্রকারান্তরে তার সুবিধা গ্রাহকরাও পাবেন। কিন্তু দেখা গেছে ত্রিপুরায় বিদ্যুৎ নিগম পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৩২২ কোটি টাকা লোন সাহায্য পাওয়ার আশ্বাস পেলেও এরাজ্যে বিদুতের বিলে এখন পর্যন্ত এক টাকাও ছাড় দেয়নি। উল্টো অতিসত্বর বিল মিটিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। এমনকি তিন মাসের গড় হিসাব করে বিল পাঠানোর নামে বহুক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছে সাধারন সময়ের থেকেও বেশি অর্থরাশির বিল এসএমএস করে পাঠানো হচ্ছে। বিপিএল রেগার শ্রমিকরা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল, জলের বিল, পূরকর মেটানোর জন্যে তাগাদা পাচ্ছেন। বলা হচ্ছে ঋণ করে হলেও নাকি এইসব বকেয়া বিল মিটিয়ে দিতে হবে। অথচ, বিত্তবানদের পরিচালিত এনবিএসসি, পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গুলিকে বাঁচাতে লক্ষ কোটি টাকার ছাড় ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী বলেন অন্নদাতা কৃষকদের ঋণ নিয়েই তাদের সার বীজ কীটনাশক কিনতে হবে। নিজের টাকায় কৃষি ক্ষেতে সেচের জলের ব্যাবস্থা কৃষদেরই স্বউদ্যোগে করতে হবে।
21.কৃষির পরিকাঠামো পুনরুজ্জীবন, পরিবহন, বিপনননে এক লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজ ১৫ মে ২০২০ ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পের ঘোষণার তৃতীয় কিস্তিতে কৃষিক্ষেত্রকে ঘিরে একাধিক পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের নামে কৃষির পরিকাঠামো, পরিবহন, বিপনন ক্ষেত্রের উন্নয়নে ১লক্ষ কোটির আর্থিক পুনরুজ্জীবন প্যাকেজের দেওয়া কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু, ১ লক্ষ কোটির, কৃষি প্যাকেজের সেই টাকাও খরচ করা হবে কৃষি সহযোগী নানা ক্ষেত্রে, সরাসরি প্রান্তিক কৃষকদের জন্যে নয়। এর মধ্যে কোল্ড স্টোরেজ তৈরী, কৃষিপণ্য পরিবহন ও বিপণনের মতো ক্ষেত্রে। অর্থমন্ত্রী যদিও বলেছেন, এর ফলে কৃষক ও কৃষি সমবায় সমিতিগুলি লাভবান হবেন কিন্তু মৎস্যচাষ, পশুপালন, দুগ্দ্ধ উৎপাদন, মৌমাছি পালনের মতো কাজে যুক্ত কৃষকদেরও সরাসরি কিছু না দিয়ে ঋণের জালেই ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছে। কেননা, মৎস্য চাষের প্যাকেজ ২০ হাজার কোটি টাকা রাখা হলেও এর মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে সামুদ্রিক মৎস্যচাষ, শিকার ও রপ্তানির ক্ষেত্রে। বাকি ৯ হাজার কোটি দেওয়া হবে অন্তর্দেশীয় মৎস্যচাষের জন্য। তাহলে মৎস্য ক্ষেত্রে ত্রিপরার মত ছোট রাজ্য গুলি কি পেল বলুন তো? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ২২ মে, ২০২০ সচিবালয়ে করোনা প্যাকেজের ব্যাপারে সাংবাদিক সন্মেলন করে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনায় ত্রিপুরা ৯১.৮২ কোটি টাকা পেতে পারে। কিন্তু এই টাকা কি অনুদান হিসাবে নাকি ঋণ হিসাবে দেওয়া হবে মৎস্যচাষিদের তাও তিনি স্পস্ট করে কিছুই বলেননি। অবশ্য মৎস্যচাষিদের আরও একটি বড় স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন একথা বলে যে ডুম্বুর, রুদিজলা সহ রাজ্যের বড় বড় জলাশয় গুলির উন্নয়নে এবং ছোট বড় মৎস্য চাষিদের সহায়তায় ৫০০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নাকি দিল্লিতে পাঠিয়ে রেখেছেন। এছাড়া প্রানীসম্পদ উন্নয়ন পরিকাঠামোর নামে ত্রিপুরা সরকার নাকি ২০ লাখ কোটির আত্মনিরভর ভারত বা করোনা প্যাকেজ থেকে ২৪.১১ কোটি, ভেষজ চাষ পদ্ধতির বিকাশে ৬ কোটি (৫০০ হেক্টর), মৌমাছি পালনে পাওয়া যাবে ৫ কোটি (৫০০ হেক্টর), কৃষি পন্য সামগ্রীর পরিবহন ও গুদামজাত করার ব্যাপারে পাওয়া যাবে ০.৮৫ কোটি। এছাড়া কৃষি পরিকাঠামোর উন্নয়ন, নয়া কৃষি উদ্যোগ স্থাপন, স্টার্ট আপ, এফপিও, পিএসসি-গুলিকে ঋণ সাহায্য দেওয়ার জন্যে ত্রিপুরার ব্যাঙ্ক গুলিকে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হবে রাজ্য সরকারের মাধ্যমে।
22. ডেয়ারি শিল্পের জন্য বিশেষ প্যাকেজ লকডাউনের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ ডেয়ারি শিল্পের জন্য প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার কোটির। যার মধ্যে দুগ্দ্ধজাত সামগ্রী রপ্তানি ও উৎপাদন শিল্পে ইনসেনটিভের মত ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু সরাসরি গো-পালকদের জন্য কোনও সাহায্যের কথা বলা নেই। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন গোমতী ডাইরি ছাড়া আর কোন ডাইরি শিল্প ত্রিপুরাতে নেই। তাই ১৫ হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় বরাদ্দ থেকে ত্রিপুরার ভাগে জুটবে ৫০ লক্ষ টাকা। এবং সেই টাকাও যাবে আগরতলা ডাইরির কোষাগারে। লকডাউনের কারনে যতই ক্ষতিগ্রস্থ হোক গোপালনের সাথে যুক্ত কেউ কোনও সাহায্য পাবেনা কোনভাবেই।
23.খাদ্য প্রক্রিয়াকরন শিল্পক্ষেত্রে প্যাকেজের অঙ্ক দশ হাজার কোটি টাকা।
লকডাউনের কারনে ক্ষখতিগ্রস্থ ডেয়ারি শিল্পের মত খাদ্য প্রক্রিয়াকরন শিল্পক্ষেত্রেও প্যাকেজের দশ হাজার কোটি টাকা সরাসরি এই শিল্পের উদ্যোগীদের সাহায্যার্থে দেওয়া হবে না। কেসিসি, স্ট্রিট ভেন্ডারদের মতো এক্ষেত্রেও কেউ চাইলে তাদেরকে ঋণ হিসাবেই এই সাহায্য দেওয়া হবে। ত্রিপুরার এরকম ১০০ মাইক্রো ফুড এন্টারপ্রাইজকে ১০ কোটি টাকা লোন বা ঋণ হিসাবে দেওয়া হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ২২ মে ২০২০ সাংবাদিক সন্মেলনে বিষয়টি এমনভাবে উত্থাপন করেছেন যে ত্রিপুরার মাইক্রো ফুড এন্টারপ্রাইজগুলি বিশেষ একটা আর্থিক সাহায্য পেতে চলেছে।
24.কয়লায় বেসারকারি সংস্থাকে আমন্ত্রণ ও প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ ১৬ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষিত আত্মনির্ভর ভারত কর্মসূচীতে সংস্কারের তরফে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে কয়লায় বেসারকারি সংস্থাকে আমন্ত্রণ ও প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা হবে। নতুন ৫০০ কয়লা ব্লকে উত্তোলনের ভার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে। কয়লায় সরকারের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান হতে চলেছে বলেও ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। প্রশ্ন উঠেছে লকডাউনের সময়ে শ্রমিকরা যখন পথে পথে হাঁটছেন, তখন এটা কি কয়লায় বেসারকারি সংস্থাকে আমন্ত্রণ ও প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করার সময়? এতে করে কি করোনা মহামারীতে আক্রান্ত গরীব মানুষের পেটে্ ভাত জুটবে? ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক রাজ্য গুলি ছোটখাট শিল্প কারখানার মালিকরা যেখানে কয়লার অভাবে ধুঁকছে সেখানে তাদেরকে বিশেষ একটা আর্থিক অনুদান না দিয়ে ব্যাঙ্ক লোন নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকার যেভাবে দায়িত্ব খালাশ করেছে তার থেকেই বোঝা যায় করোনা মহামারী মোকাবেলার নামে আর্থিক প্যাকেজটি কাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
25. সামাজিক পরিকাঠামো বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে নতুন নির্মানে ৮১০০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকেও উৎসাহিত করতে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে। সামাজিক পরিকাঠামো বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে নতুন নির্মানে ৮১০০ কোটি টাকা খরচ কীভাবে করা হবে এব্যাপারে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যদিও প্যাকেজ ঘোষণাকালে বিস্তারিত কিছু বলেননি কিন্তু এক্ষেত্রেও যে বেসরকারি উদ্যোগকেই উৎসাহিত করতে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে এটা মোটামুটি তিনি স্পস্ট করে দেন। অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে গনবন্টন ব্যাবস্থাপনা কিংবা কৃষিক্ষেত্রের জন্যে সার বীজ সরবরাহ, সবই যে বেসরকারি হাতে যাচ্ছে তা করোনা মহামারীর আবহে গরিব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার নামে ঘোষিত প্যাকেজে সারাংশ থেকেও একরকম স্পস্ট। কেননা, ইমারজেন্সি হেলথ রেসপন্স প্যাকেজের নাম করে ৮১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও ত্রিপুরার মত রাজ্যকে মাত্র ১৭.৮৪ কোটি টাকাই দেওয়া হয়েছে।
26.ভাড়ায় থাকা শ্রমিকদের সমস্যা সুরাহায় বিশেষ প্যাকেজ ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন জানান, ভিন্ন রাজ্যে কাজে গিয়ে বেশি টাকায় ভাড়ায় থাকাটা শ্রমিকদের কাছে অন্যতম বড় সমস্যা। তার থেকে কিছুটা সুরাহা দিতে এবার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো কোন প্রকল্পে বাড়ি তৈরি করা হবে। সেই সব বাড়িতে কম ভাড়ায় থাকতে পারবেন শ্রমিকরা। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এই সব বাড়ি তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের নিজস্ব জমিতে আবাসন তৈরি হতে পারে, উদ্দ্যোগপতিরা নিজের জমিতেও এই ধরনের আবাসন তৈরি করতে পারেন, বা রাজ্য সরকার তাদের জমিতেও এধরনের আবাসন নির্মান করতে পারেন। খুব শিগগিরই প্রকল্পের খুঁটিনাটি ঘোষণা করা হবে। লকডাউনের এই কঠিন সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে পোঁছানোর কোনও উদ্যোগ না নিয়ে অন্য রাজ্যে তাদের থাকার ব্যাবস্থা তৈরি করে দেওয়ার নামে কাকে সুবিধা করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। আর এটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন ৬ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত যাদের বার্ষিক আয়, তাদের গৃহ নির্মানের জন্য ক্রেডিট লিঙ্ক সাবসিডি স্কিমের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত করার মধ্য দিয়ে। কেননা, লকডাউনের নামে গরিবদের সাহায্য করার নাম করে বাস্তবে কিছু কর্পোরেটদের পাইয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটা হয়েছে। অথচ আদিবাসিদের কর্মসংস্থান, বনসৃজন, পতিত জমি পুনরুদ্ধার করে চাষবাস ইত্যাদির জন্য ৬০০০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের প্রস্তাব বিভিন্ন রাজ্য থেকে দেওয়া হয়েছিল, যা লকডাউনের এই কঠিন সময়েও কাজের সুযোগ তৈরি করতে পরতো। কিন্তু এই প্রকল্প গুলিকে ১০ দিনের মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হবে বলেও এখন পর্যন্ত কিছুই করা হল না।
এক্ষেত্রে এক রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্য রাজ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার নাম করে স্কিম ঘোষণা করে নিকট দিনে যে নিজেদের পছন্দের কিছু কর্পোরেটদের সুবিধা করে দেওয়া হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা ৬০০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে অথচ তার কোন রূপরেখা আজ পর্যন্ত ঘোষণা করা গেল না। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীও ২২ মে, ২০২০ করোনা প্যাকেজের সাংবাদিক সন্মেলনে এব্যাপারে স্পস্ট করে কোনও কিছু বলতে পারলেন না।
27. শ্রম আইন সংস্কারের শ্রম আইন সংস্কারের বিষয়টি যখন সংসদের বিবেচনায় রয়েছে তখন ১৪ মে ২০২০ অর্থমন্ত্রী সীতারামন জানান, জাতীয় স্তরে ফ্লোর রেট স্থির করতে চাইছে কেন্দ্র। শ্রমিকদের নিয়োগ করলে নিয়োগ পত্র দিতেই হবে। বছরে অন্তত একবার তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে। এসব ধারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্তমান শ্রম আইনেও বলা আছে। কিন্তু কঠোর ভাবে এগুলি বাস্তবায়ন না করে ৪৪টি শ্রম আইনের সমন্নয় ঘটিয়ে বা বলা যেতে পারে মিলিয়ে দিয়ে চারটি শ্রম কোড তৈরি করে শ্রম আইনে ব্যাপক রদবদল করার চেষ্টা হচ্ছে। যেখানে নতুন নিয়মে এক জন শ্রমিককে ১২ ঘন্টা কাজ করতে হবে। লকডাউনের এই কঠিন সময়ে শ্রম আইন সংস্কারের এমন কি প্রয়োজন হয়ে পড়ল অনেকেই এই প্রশ্নও তুলেছেন। এই মুহূর্তে করোনা আবহে নয়া আইনের কেউ বিরোধিতা করতে পারবেনা এই ধরনের একটা মনোভাব থেকে তাই লকডাউনের ডামাডুলের মধ্যে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী একটা স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা হিসাবে এটা করা হয়েছে তা তো বলাই বাহুল্য।
(লেখক তাপস দে রাজ্যের একজন প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক ও প্রবীণ সাংবাদিক )