ওপারের ঘটনা প্রবাহে উদ্বেগ
পান্নালাল রায়
February 9, 2025
বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ এপারে নানা কারণে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।বঙ্গবন্ধু মুজিব সহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশটি আজ কোন পথে এগিয়ে চলেছে।এদিকে ক'দিন আগে পাকিস্তানের আইএসআই শীর্ষ আধিকারিকদের বাংলাদেশ সফর ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।উত্তর পূর্বাঞ্চলে ফের অশান্তির আবহ সৃষ্টির তৎপরতা চলছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় নানা ভাবেই উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টাও চলছে।কখনও কাঁটাতারের বেড়ার কাজে ওপারের প্রতিবন্ধকতা,কখনও পাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ছে বিএসএফ,কখনও আবার সীমান্তের ওপারে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে এপারের জন্য ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর পূর্বাঞ্চলের জন্য উদ্বেগের বার্তা বয়ে এনেছিল। ওপারে জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলনের সময় ভারত বিরোধী জিগির অবশ্য আগেই এই সংকেত দিয়েছিল। কোটা বিরোধী আন্দোলনটি যে নিছক কোনও সাদামাটা ছাত্র আন্দোলন নয়,এর পেছনে যে গভীর কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে সবাই না বুঝলেও কেউ কেউ তা বুঝে গিয়েছিলেন! ৫ই আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দেশত্যাগের পর ভারত বিরোধী জিগির যেমন তুঙ্গে উঠে তেমনই পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগী হয় দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার। আর পাশাপাশি চলতে থাকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অকথ্য নির্যাতন। বাড়তে থাকে মৌলবাদীদের তৎপরতাও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ কোন পথে যাচ্ছে তা ধারণা করতে মোটেই অসুবিধা হয় না।পাকিস্তানের শিল্পীদের এনে অনুষ্ঠান করা হয় বাংলাদেশে।আসেন ধর্মীয় নেতারা।পাকিস্তানের কেউ কেউ বাংলাদেশ সফরে এসে এমনটাও বলেন যে,পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র তারা নিজেদের বলেই ধরে নিতে পারে।এমন প্রচ্ছন্ন হুমকি আর যুদ্ধ যুদ্ধ রব তোলা হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে।কখনও বলা হয় কলকাতা দখলের কথা,কখনও আবার উত্তর পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম করাচি বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে।শুরু হয় দু'দেশের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের পাকিস্তান সফরের পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই'র আধিকারিকরা বাংলাদেশ সফর করেন।সাম্প্রতিক ঘটনা হল বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান সহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ সব ধ্বংস করে দেয়া।ঢাকার ধানমন্ডিতে একদল উশৃঙ্খল জনতা মুজিবের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় হাসিনার বাড়িতেও। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ণ ধ্বংস করা হয়।প্রতিরোধহীন ভাবে বাংলাদেশে এইসব ধ্বংস যজ্ঞ চলতে থাকে।পরে ইউনুস সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে মুজিবের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনাকে অনভিপ্রেত বলেও একে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই বিবৃতিতে মন্তব্য করা হয়।
বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ নানা ভাবেই এপারে প্রভাব ফেলছে। আখাউড়া হয়ে আগরতলার সঙ্গে বাংলাদেশের রেল সংযোগ,চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগের জন্য ত্রিপুরার সাব্রুমে মৈত্রী সেতু ইত্যাদি হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষিতে এই সব প্রকল্পের ভবিষ্যত এখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়েছে।এদিকে সীমান্ত এলাকায় নানা অশান্তি সৃষ্টির প্ররোচনাও চলছে। ভারত- বাংলাদেশের মোট ৪০৯৬ কি.মি দৈর্ঘ্যের সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে সর্বাধিক দৈর্ঘ্যের সীমান্ত-২২১৭ কি.মি।বাকি সবটাই রয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলে।অসমে ২৬২ কি.মি, মেঘালয়ে ৪৪৩ কি.মি, মিজোরামে ৩১৮ কি.মি এবং ত্রিপুরায় রয়েছে ৮৫৬ কি.মি দৈর্ঘ্যের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা।এই সব সীমান্ত এলাকার কিছু কিছু অংশে বর্তমানে নানা ভাবে উত্তেজনা সৃষ্টির প্ররোচনা চলছে ওপার থেকে। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকার কিছু অংশে কাঁটাতারের বেড়ার কাজে ওপার থেকে বাধা এসেছে। ত্রিপুরার কৈলাসহরের মাগুরুলি গ্রামে সীমান্ত এলাকায় পাচার প্রতিরোধের কাজে ওপারের দুষ্কৃতীদের হামলার মুখে পড়েছে বিএসএফ। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে দু'দেশের সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।কৈলাসহরের রাঙ্গাউটি এলাকায় সীমান্তের ওপারে হঠাৎ করে মণু নদীর পাড়ে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে এপারে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করা হয়েছে।ত্রিপুরা বিধানসভায় ওপারের এই বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।স্হানীয় বিধায়ক বীরজিত সিংহ এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।এদিকে কালাপানিয়া খালে বাংলাদেশের বাঁধ নির্মাণের ফলে রাজধানীর জল নিষ্কাশনে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম নানা ভাবেই সীমান্ত এলাকায় আশঙ্কা উদ্বেগের সঞ্চার হচ্ছে।ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় নানা অপরাধ মূলক ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়।তা প্রতিরোধে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রয়েছে।দু'দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে মাঝে মাঝে রুটিন বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহের বিরূপ প্রভাব পড়ছে সীমান্তে।
এবার আসা যাক উত্তর পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার প্রসঙ্গে।এক সময় এই অঞ্চলের সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ গোপন ঘাঁটি ছিল বাংলাদেশের কিছু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। সেই সব ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা করে বৈরীরা আবার ফিরে যেত তাদের নিরাপদ আস্তানায়। তাই তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ছিল কষ্টসাধ্য। কিন্তু হাসিনা সরকার ভারতের অনুরোধে সেইসব বৈরীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়,তাদের ঘাঁটিগুলো গুড়িয়ে দেয়।বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে থাকা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে তখন।তাদের বেশিরভাগই আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।কিছু কিছু গ্রেপ্তার হয়।এই ভাবে পূর্বোত্তরে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা স্তিমিত হয়ে আসে।দীর্ঘ কয়েক দশক পর উত্তর পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার অবসান ঘটে।ফিরে আসে শান্তির বাতাবরণ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে উত্তর পূর্বাঞ্চলে আবার সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে।ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গিদের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।মিজোরামে বহু আগ্নেয়াস্ত্র সহ জঙ্গি ধরা পড়ার খবর পাওয়া গেছে।ত্রিপুরার জম্পুই পাহাড়ের পাদদেশের কাঞ্চনপুর এলাকায় সন্ত্রাসবাদীরা চাঁদার হুলিয়া জারি করেছে।বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর পূর্বোত্তরে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এই দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্রের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।সম্প্রতি মিজোরামের মামিত জেলায় ছয়টি এ কে ৪৭ রাইফেল এবং দশ হাজার গুলি ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র সহ ছয় জন মিজোরাম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ত্রিপুরার কাঞ্চনপুরের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল হয়ে তারা মিজোরামে প্রবেশ করে বলে খবর।কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশের গোপন শিবিরে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বৈরীরা কাঞ্চনপুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের ঘাঁটি থেকে বৈরীরা ত্রিপুরায় ঠিকাদারদের চাঁদার হুমকি দিচ্ছে এ রকম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।সম্প্রতি পাকিস্তানের আইএসআই'র এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছেন। এর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকদের এক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করেন এবং সে দেশের সামরিক আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।এই ভাবে দু'দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে।ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধির জয়সোয়াল অবশ্য বলেছেন, ভারত এ ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখছে এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।শুধু আইএসআই'র বাংলাদেশ সফরই নয়, সে দেশে মৌলবাদীদের লাগাতর ভারত বিদ্বেষী জিগির চলছে।সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টির প্ররোচনা চলছে।কাঁটাতারের বেড়ার কাজে বাধা দেয়া হচ্ছে।সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি সহ সীমান্তবাসীদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে।অথচ ভারত বরাবরই সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সকলের উন্নয়নে আগ্রহের কথাই বলে আসছে।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওপারের ঘটনা প্রবাহে এর বিপরীত চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে! বাংলাদেশ মৌলবাদীদের কতটা মৃগয়া ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এবং দেশটি কোন পথে এগিয়ে চলেছে তা স্পষ্ট মালুম হচ্ছে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ণ ধ্বংসের সাম্প্রতিক ঘটনায়!
আরও পড়ুন...