অ্যালবাম

বেনিমাধব দেবনাথ

"বাবা, এটা কি তুমি? এ যে একেবারে বীরাপ্পনের মতো দেখতে, তুমি এমন ছিলে বাবা ?" - শিলং পাহাড়ে তোলা আমার ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িওয়ালা ফটো খানা দেখে শ্রীমানের সকৌতুক জিজ্ঞাসা। ছেলের মা অবশ্য বীরাপ্পনের মর্যাদা দিতে নারাজ, 'খাসিয়া মামা'র তকমা এঁকে দিতে বরঞ্চ বেশি তৎপর, কিছুক্ষণ আগের দ্বৈরথের আঁচ গিয়ে পড়েছে বেচারা ছবিটার উপরে। কপাল বটে আমার, ছেলে দ্রাবিড় প্রেমী তো বউ মোঙ্গল বিলাসী! উদাসীন ভাবে বউ-ছেলেকে বললাম "তোরা দুজনেই কিছুটা ঠিক বলেছিস। বাঙ্গালিরা নৃতাত্ত্বিকভাবে দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলদের সংমিশ্রণ।" বাঙালীদের নিয়ে এমন জেনারেলাইজেশন দুজনেরই অবশ্য ঘোরতর অপছন্দ। তাই প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেলো। হাঁড়ি-মাথা গোলমুখ বঙ্গবাসীদের আর্য প্রক্সিমিটি নিয়ে তারা নিঃসেন্দহ! নিদেনপক্ষে বাঙালীরা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড তো বটেই, মা-ছেলের অভিমত।

পুরোনো অ্যালবাম গুলো খুলে বসেছি লক ডাউনের বিকেলে। সবাই কাড়াকাড়ি করে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একগাদা ছবির উপর। সবই বহু পুরোনো, প্রাক-ডিজিটাল, ফুজি-কোডাক বা জাপানি ইয়াসিকা যুগের। তখনো গিগা বাইট টেরা বাইটের মেমোরি কার্ড, পেন ড্রাইভ, এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক এসব আসেনি। শুরু হয়নি চিপের কারসাজি। স্মৃতি ধরে রাখার সবচেয়ে ভালো পন্থা ছিল ক্যামেরাতে স্ন্যাপ নেওয়ার পর গ্লসি বা ম্যাট পেপারে প্রিন্ট করে অ্যালবাম বন্দী করে রাখা।

বিছানার উপর ছড়ানো ছিটানো ছবিগুলো ঐ যুগের সাক্ষ্য বহন করছে। বেশির ভাগ ফটোই চাকুরির প্রথম জীবনের।পুরনো অ্যালবামে স্মৃতির সূতো টেনে, হারিয়ে যাওয়া সময়কে তুলে আনতে চাইছিলাম।

একটা ছবি দেখিয়ে ছেলে জিজ্ঞেস করলো, "এছবিটা কোথাকার বলো তো?" হাতে নিয়ে খানিকটা দেখে বললাম, "বমডিলা হিল টপ থেকে তোলা, ভূটানের মাউন্টেইন রেঞ্জ।রোদ ঝলমলে পরিষ্কার আকাশ না হলে এমন ছবি তোলা সম্ভব নয়। পাহাড়ের মাঝের অংশটা দেখ,ন্যাড়া ধূসর রঙের পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। গাছপালা নেই, উপরটা সাদা বরফে ঢাকা।"

"কেন, গাছপালা নেই কেনো?" ছেলে জানতে চাইলো।

জিওগ্রাফির কাঁচা বিদ্যা ফলিয়ে উত্তর দিলাম,"পাহাড়ে ঠাণ্ডা ও অন্যান্য কারণে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার উপরে বড়ো গাছপালা জন্মাতে পারে না।" ছবিটা হাতে নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।স্মৃতিরা সব ভিড় করে এলো, বমডিলার প্রবাস বাসের কথা মনে পড়ে গেল।

আমার অফিস কাম কোয়ার্টারের মেন গেটের দুপাশে কয়েকটা বড়ো বড়ো পাইন গাছ, হিমালয়ান জিমনোস্পার্ম, সূঁচের মতো সবুজ পাতা ছড়িয়ে এই আট হাজার ফুটি ঠাণ্ডায় সারাক্ষণ সোজা হয়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এদের সামনে দিয়ে জাতীয় সড়কটি চড়াই উতরাই হয়ে, পাকদণ্ডি মেরে মেরে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে উত্তর দিকে চলে গেছে একবারে তাওয়াং পর্যন্ত। এ দিকটায় হিমালয় উঁচু হতে হতে বরফ ঢাকা সে লা পাসে(Se la pass) চৌদ্দ হাজার ফিটে গিয়ে ঠেকেছে, তারপর আবার নিচু হতে হতে তাওয়াং গিয়ে নয় হাজার ফিটে থেমেছে। তাওয়াং শহর থেকে আর কয়েক কিলোমিটার উত্তরদিকে গেলেই চাইনিজ বর্ডার, সাবেক তিববত। আর বমডিলার দক্ষিণ দিকে ট্যাঙ্গা ভ্যালি, জিরো পয়েন্ট, ভালুকপং হয়ে রাস্তাটি নিচু হতে হতে চলে গেছে তেজপুর পর্যন্ত। নামে জাতীয় সড়ক হলেও দুটো বড়ো গাড়িও পাশাপাশি যেতে অসুবিধে হয়। উল্টো দিক থেকে কোনো বড়ো গাড়ি এলে, একটিকে একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যটিকে পাশ দিতে হয়। বড়ো বিপজ্জনক রাস্তা, একদিকে খাড়া পাহাড় তো অন্য পাশে অতল খাদ! সেদিকে নজর গেলে আত্মারাম ভয়ে খাঁচা ছেড়ে যেতে চায়! হয়ত রাস্তার উপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণা, কোথাও মাথার উপরেই বিশাল একখণ্ড পাথর এমন ভাবে ঝুলে আছে যে মনে হয় এক্ষুনি বুঝি নিচে গড়িয়ে এসে গাড়ি সুদ্ধু গুঁড়িয়ে দেবে! প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত মোড়, খাদ, কুয়াশা, ল্যাণ্ড স্লাইডের ভয়ঙ্কর বিপদ। পিতৃদত্ত প্রাণটি হাতে নিয়ে চলতে হয় সর্বক্ষণ।

তবে এই ভয়ঙ্কর বিপদ সঙ্কুল পথকেও হার মানিয়েছে এপথের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। ভালুকপং হলো কামেং ডিস্ট্রিক্টের এন্ট্রি পয়েন্ট, ইনার লাইন পাস চেক হয় এখানে। পাহাড়েরও শুরু এখান থেকেই। পথ চলার সময় ডান দিকে কামেং নদীটি লুকোচুরি খেলতে খেলতে সাথে সাথে চলছে। অবশ্য ওর খর স্রোতের গতি আমাদের উল্টো দিকে, লক্ষ্য ব্রহ্মপুত্র। এ নদী এক একবার কাছে আসছে আবার পাহাড় জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে। বুকে ধরে আছে বড়ো বড়ো বোল্ডার আর নানান রঙের স্টোন।শহরে খুব কদর এসব স্টোনের, ডেকোরেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। আরো কিছুটা এগোলে নীচে পাহাড়ের ঢালে সবুজের ঘন অরণ্য। সেখানে বড়ো বড়ো গাছে পরাশ্রয়ী অর্কিড ও তার ফুলের সমাহার চোখ ও মনকে মনোরম আনন্দ দেয়। বার্ড ওয়াচাররা দুষ্প্রাপ্য হিমালয়ান পাখির দর্শন পেতে পারেন। কখনো কখনো রাস্তাটি এত উঁচু দিয়ে যায় যে, চোখের সামনে দূর দূরান্ত পর্যন্ত অগণিত পর্বত শৃঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নজরে আসবে না। সে দৃশ্য আটপৌড়ে মানুষের চোখ এবং মনকে বিহ্বল করে দেয়। সৃষ্টির এমন আদিগন্ত বিশালতার সামনে ক্ষুদ্র মানুষের মস্তষ্ক অজান্তে নত হয়ে আসে।

জিরো পয়েন্টে এসে সেপপা আর বমডিলার রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। ডান দিকে নদী পার হয়ে সেপপার রাস্তা। আমরা সোজা বমডিলার রাস্তা ধরে চলতে থাকব। এই রাস্তায় ট্যাঙা ভ্যালির কথা একটু আলাদা করে বলতে হয়।

বমডিলা থেকে ট্যাঙা ভ্যালির দূরত্ব কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার। বাষট্টিতে চীনের হানাদার সেনাবাহিনী বমডিলা দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে ছিলো। বমডিলাতে ভারতীয় ফৌজ প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধের পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মনোরম ট্যাঙা ভ্যালিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশাল বেস ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। বাষট্টির ঐ আক্রমণের কথা স্মরণে রেখে প্রতি বছর ট্যাঙা ভ্যালি থেকে ভারতীয় সেনার বিশাল কনভয় তাওয়াং পর্যন্ত মহড়া দেয়। বোফর্স কামান এই কনভয়েই প্রথম চাক্ষুষ করি আমার বমডিলার অফিসের বারান্দা থেকে।

পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে অর্ধ চন্দ্রাকারে বমডিলা শহরটি গড়ে উঠেছে। বিশাল পাহাড়ের ভীষণ খাড়া ঢাল, তার মধ্যেই পাহাড় কেটে খোপে খোপে তৈরী হয়েছে স্কুল, কলেজ, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, সরকারের জেলা প্রশাসনিক অফিস, বাজার, রাস্তা, আসাম প্যাটার্নের বাড়ি-ঘর। ঘর থেকে বেরোলেই হয় চড়াই নতুবা উৎরাই অতিক্রম করতে হবে।দুটোই খুব কষ্টকর। কিন্তু স্থানীয়রা অনায়াসে তরতরিয়ে চলা ফেরা করছে।

এখানকার লোকজন অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। অনেক তিব্বতি বৌদ্ধ লামাকে দেখেছি যারা হোটেল ও নানান ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আর আছে স্থানীয় মংপা এবং অন্যান্য উপজাতি।

এ শহর ফুলের শহর। মনে হয় ফুলের মেলায় এসেছি। রাস্তা-ঘাট, এখানে সেখানে সর্বত্র নানান রঙের নানান ফুল ফুটে আছে। এসব ফুল কেউ লাগায়নি, কাউকে যত্নও করতে হয় না। এখানকার প্রকৃতিই এদের জন্মদাত্রী এবং লালন-পালনও তিনিই করেন। এ শহরের নাম 'ফুলবাহার' বা 'গুলবাহার' হলে বোধহয় প্রকৃতির অঢেল কৃপার সঙ্গে সুবিচার হতো ভালো।

আট হাজার ফিট উপরে যেন মেঘেদের দেশে বসবাস করছি। মেঘেরা এসে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে যখন তখন। সারাক্ষণ দুষ্টুমি আর এখানে সেখানে লুকোচুরি। বৃষ্টি হয়ে না ঝরেও, শরীর পোশাক ভিজিয়ে দেয়!মনকেও কি ভিজিয়ে দেয় না? প্রায় সব সময় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাড়-মাস জমে বরফ হয়ে যাবার যোগাড়। বুখারি'র(ফায়ার প্লেসের অরুণাচল সংস্করণ) সামনে না বসে উপায় নেই।

শীতের কয়েক মাস ছাড়া সূর্যি-মামার দেখা পাওয়া ভার। রোদ যে কতো দামী সেটা এখানে না এলে বুঝতাম না। যেদিন রোদ উঠতো, ছোট্ট শহরটা এবং দৃশ্যমান আশ-পাশের চেহারাটা পাল্টে যেতো একেবারে অলৌকিক ভাবে। এমন সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা শুধু দেবলোকেই সম্ভব। ঈশ্বরের করুণার মতো নিষ্কলঙ্ক নীলাকাশ। ঠাণ্ডা বাতাসকে সোনা ঝরা মিঠে রোদে দেবতার আশীর্বাদের মতো মনে হয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতো সত্যিই আমার সশরীরে স্বর্গ দর্শন হয়েছে এই বমডিলাতেই।

সময় বয়ে গেছে আপন খেয়ালে, কিন্তু আমার পুরনো অ্যালবামের ছবিতে কতকাল আগের সময় কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে আছে! ছবি তো শুধু ছবি নয়, অতীতের দলিল, নির্বাক দৃশ্যমান সাক্ষী। কথা না বলেও অনেক কিছু বলে দেয়। হারানো অতীতকে খুঁড়ে তুলে এনে মনে মনে দেখে, ছুঁয়ে, আদর করে সুখ পেতে চায় হৃদয়। আর হারিয়ে গেছে বলেই অতীতকে এত দামী, এত আদরের মনে হয়। এতদিন আগের সব কিছু এখন কেমন আছে কি জানি? বমডিলার স্মৃতি সত্যিই আমার কাছে অনন্য।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.