এমন কঠিন দিনেও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলো না সুপ্রিম কোর্টও!
পুরুষোত্তম রায় বর্মণ
গত মে ৬, ২০২০ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকার পঞ্চম পাতায় নিচের দিকে ৫ কলাম জুড়ে ছবিসহ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। এক পরিযায়ী শ্রমিকের কাহিনী। নাম তার মহম্মদ জুবেদ। বয়স ২৮ । বাড়ি বিহারের আড়াড়িয়ায়। পোলিও আক্রান্ত। দুটো পা অচল। আবার এর সাথে বাঁ হাত ও চলৎশক্তিহীন। দিল্লিতে জুবেদ কাজের খোঁজে মাস চারেক পূর্বে গিয়েছিল এবং গাজীপুর মান্ডিতে দৈনিক ২০০ টাকা হাজিরার ভিত্তিতে মাছ কাটার কাজ পেয়েছিল। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল লকডাউন। কয়েকদিনের মধ্যেই জুবেদের রেশন শেষ। কোন সরকারি সাহায্য জুবেদের কপালে জোটেনি। তাই জুবেদ ঠিক করল না খেয়ে বিদেশ বিভুই হয়ে মরার চাইতে যেকোনোভাবে দেশে ফেরাই একমাত্র রাস্তা। জুবেদের সম্বল একটি ট্রাইসাইকেল। ২৩ তারিখ থেকে ট্রাই সাইকেলে যাত্রা শুরু। কিছু চাল, গুড়, নোনতা জোগাড় করে ট্রাই সাইকেলে চাপল জুবেদ। রওনা দিল বিহারের আড়ারিয়ার উদ্দেশ্য। ডানহাতে ট্রাই সাইকেল চালিয়ে দৈনিক ৫০-৬০ কিলোমিটার অতিক্রম করে জুবেদ এসে পৌঁছেছে ইউপি বিহারের সীমান্তে অবস্থিত গোপালগঞ্জে। জুবেদ এখন ট্রাই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইনে পঞ্জিকরণের জন্য । দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত জুবেদ যদি কোন বাস পায় তাহলে বাসে ট্রাইসাইকেল তুলে দিয়ে বাকি পথটা পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছবে। জুবেদের জন্য সরকার নেই। জুবেদদের জন্য আদালত নেই। জুবেদদের একমাত্র ভরসা দুটো পা। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হেঁটেছেন কয়েক হাজার কিলোমিটার, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাড়ি পৌঁছেছেন। কেউবা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন গুজরাট থেকে আসাম, পাঞ্জাব থেকে বিহার, মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবাংলা। এই পদযাত্রা নতুন ইতিহাস ভারতবর্ষের বুকে খোদাই করেছে। ভারতবর্ষের জাতীয় সড়ক গুলোর প্রতিটি মাইলে মাইলে। রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা, শাসকের নৃশংসতা, শ্রেণী রাষ্ট্রের নগ্ন পিশাচ নৃত্য, আদালতের চেহারা। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন মরণের প্রশ্নে দায়ের করা গুরুত্বপূর্ণ মামলা, পরিযায়ী শ্রমিকদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ মামলা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা হাসতে হাসতে খারিজ করে দিয়েছেন, বলেছেন সরকারের উপর বিশ্বাস রাখা ভালো। সুপ্রিম কোর্টের এই ভূমিকা দেখে বিচারপতি লুকুর, যিনি এক বছর পূর্বেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন, এখন অবসরে গেছেন, তিনি সখেদে বলেছেন যে সুপ্রিমকোর্ট জাতির দুর্দিনে জাতির পাশে দাঁড়াতে পারছে না । ১৯২০ এর দশকে হাউজ অফ কমনসে একটি বক্তৃতায় উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণী প্রায়ই প্রশ্ন করে, আমাদের ব্যথা ও যন্ত্রণার কথা শোনার ধৈর্য এবং সময় কেন বিচারকদের থাকেনা। এই প্রশ্নের উত্তর খোজা খুব একটা দুঃসাধ্য নয়। অভিজ্ঞতাই সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িতদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে।
আজকের হিন্দু পত্রিকায় চতুর্থ পাতায় উপরের দিকে ৬ কলম জুড়ে ছবিসহ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ট্রেনে করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উত্তরপ্রদেশের লখনৌর চারবাগ রেলস্টেশনে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। সমস্ত শ্রমিকরা নিজেদের পয়সায় ট্রেনের টিকিট কেটে এসেছেন এবং তারা লকডাউনের সময় কোন সরকারি সাহায্য পাননি। অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন। রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র এখন উলঙ্গ। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতায়, শিশুটি বলেছিল রাজা তুমি উলঙ্গ। আজকে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ উলঙ্গ। শ্রেণী চরিত্র প্রকট। বিদেশে আটকে পড়াদের জন্য বিশেষ বিমান আর পরিযায়ী শ্রমিকরা যারা গত দুমাস ধরে উপার্জনহীন, খাওয়া নেই, তাদেরকে বাড়ি আসতে হচ্ছে নিজেদের পয়সায় টিকিট কেটে। দেশের অর্থনীতিতে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের চরম দুর্দিনে রাষ্ট্র তাদের পাশে নেই এবং তাদের সাথে যে ব্যবহার করছে তা চূড়ান্ত রকম অমানবিক এবং তাদেরকে মানুষ হিসেবে রাষ্ট্র দেখছে না এবং রাষ্ট্রের কাছে তারা গরু-ছাগলের চাইতেও অধম। রাষ্ট্রের মিথ্যা হিটলারের গোয়েবেলসের মিথ্যাকেও হার মানিয়ে দেয়। সোনিয়া গান্ধী সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব করলো তখন আসরে নামলেন সুব্রামনিয়াম স্বামী। তিনি রেলমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে টুইট করে জানালেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের রেলভাড়ার ৮৫% কেন্দ্রীয় সরকার দেবে এবং বাকি ১৫ শতাংশ রাজ্য সরকারগুলো দেবে। এটা এখন অব্দি শুধু ঘোষণাই। আজকে যতগুলো সর্বভারতীয় কাগজ দেখলাম সেগুলোর প্রত্যেকটিতে বলা হয়েছে শ্রমিকরা নিজেরাই ভাড়া দিয়ে এসেছেন। কর্নাটকের ঘটনাগুলো আরো ভয়ঙ্কর। কর্নাটকের রিয়েল এস্টেটের মালিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্য ছাড়তে দিলে নির্মাণ শিল্পে সমস্যা হবে। শ্রমিকের অভাবে নির্মাণ শিল্প থমকে দাঁড়াবে। তাই কর্ণাটক সরকার আটকে পড়া কয়েক লক্ষ পারযায়ী শ্রমিকদের রাজ্য ছাড়া আটকে দিয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্ণাটক থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেন গুলোকে বাতিল করা হয়েছে। মালিকদের নিরাপত্তারক্ষীরা এবং সরকারের পুলিশ বাহিনী পরিযায়ী শ্রমিকদের জোর করে আটকে রাখতে চাইছে। কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যে কোনভাবেই কর্ণাটক ছাড়তে মরিয়া। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে জোর করে আটকে রাখা মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধী। পরিযায়ী শ্রমিকরা ক্রীতদাস নয়। তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শ্রমিকদের আধুনিক ক্রীতদাস বানাতে চাইছে । এর বিরুদ্ধে কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। কর্ণাটক হাইকোর্টের ভূমিকা সুপ্রিম কোর্টের মত নৈরাশ্যজনক নয়। আন্দোলন হবে রাস্তায়। শ্রমিকরা কিন্তু রাস্তায় নেমে পড়েছেন। লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে বেশিদিন লাঠি দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভের খবর আসছে। লাঠি, টিয়ার গ্যাসের ওষুধে কিন্তু বেশি দিন চলে না। এই ওষুধ খুব সহজে অকেজো হয়ে যায়। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন, তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এই অমানবিকতার ব্যভিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে কবি সমস্ত পদক জাতীয় সড়কে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান রাখতেন, পথে নামো সবাই , এই দুরাচারের অবসানে, হাত দিয়ে মাটি থেকে টেনে তুলে বুকে নাও পরিযায়ী শ্রমিক ভাইদের। সভ্যতা তাদের কাছে ঋণী, দেশ তাদের কাছে ঋণী, মনুষ্যত্বের পরিচয়ে গর্যে উঠ সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে, দুর্বৃত্তপনার অবসানে। না হলে ইতিহাস তোমাদের ক্ষমা করবে না। তোমাদের মধ্যবিত্ত জীবন, তোমাদের আগামী প্রজন্ম কয়েক শতক ধরে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। ভাবি কাল তোমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।