ভূপেন্দ্র ভৌমিক: সমাজ শিক্ষিত শিল্পী
সৌম্যদীপ দেব
December 24, 2025
সৌষ্ঠব মানুষের ভিতর প্রাণটিকে একটু একটু করে আরো বড়ো করে তোলা। জীবন্ত, মায়াময়, আন্তরিক, মানবিক আর সামাজিক করে নেওয়া। জীবনের দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের বিকাশটি যেন সুগম হয়। জীবনের সুখ ও যাতনা বইবার মতো ক্ষমতা অর্জন। সাহিত্য, ব্যাকরণ, ভাষাগত কুশলতা, সমাজ, শিশু, সামাজিক শৃঙ্খলা, নগর সৌন্দর্যায়ন, নাগরিক জীবনের মানোন্নয়ন, শিক্ষা ও শিক্ষার প্রসার ; আরো স্পষ্ট করে বললে একজন সমাজ শিক্ষিত শিল্পী, যিনি জানতেন নাগরিক জীবন কোথায় ক্ষয়ে যায় আর কোথায় তাকে প্রাণবাবু দিতে হয়। জীয়নকাঠি মায়া দিয়ে আগলে রাখতে হয়। আজীবন তিনি এইকাজটিই জোরালোভাবে করে গেছেন। তিনি লেখক-সাহিত্যিক, ব্যাকরণবিদ্ ভূপেন্দ্র কুমার ভৌমিক (১৯৩৩-২০২৩)। শিক্ষকতা তাঁর পেশা হলেও নেশা ছিল লেখালেখি ও সমাজ সংস্কার। রাজা রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যেভাবে সমাজের অন্ধকারের তলটি আলো করে গেছেন লেখক ভূপেন্দ্র শিক্ষা ও সমাজ চেতনার প্রতি বারবার গুরুত্বারোপ করেছেন। আসলে তিনি এটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন শুধু শিক্ষা নয় সমাজ গঠনে সামাজিক মানুষের নিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। পাশাপাশি শুধু সু-সাহিত্য নয় যেকোনো ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে জাতি অবগত না হলে, তার পাঠ পরিপূর্ণ হয় না। আর এভাবেই জীবনের অভিজ্ঞতা যত বৃদ্ধি পেল ভূপেন্দ্র ভৌমিক নামটি আগরতলার শিক্ষিত সমাজে তত বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘একটি শিশির বিন্দু’ কবিতায় লিখেছিলেন— “বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,/দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু।” কবিতাটি আমার এই আলোচনায় খুব প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক এইজন্য যে, ভূপেন্দ্র ভৌমিক আমার প্রতিবেশী। তা-ও কতটা চিনতে পারলাম তাঁকে। আদৌও পারলাম কী? এক জীবনে নিজেকেই তো পরিপূর্ণ চিনতে পারে না মানুষ! কতদূরে কত কত সাহিত্যিকের কাছে গেছি, কিন্তু তাঁর কাছে কেনো যাওয়ার মতো করে যাওয়া হল না? এই প্রশ্ন আর উত্তর কোনটাই আজ আর আন্তসম্পর্কে জড়িয়ে নেই। ভূপেন্দ্র ভৌমিক চলে গেছেন ২০২৩ সালে একানব্বই বছর বয়সে। তাঁকে নিয়ে যত পড়াশোনা করেছি রীতিমতো বিস্ময় তৈরি হয়েছে। ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক রাজ্যে প্রয়াত দীনবন্ধু ভৌমিক ও সুখদা সুন্দরী ভৌমিক প্রকৃতই এমন সন্তানের জন্য রত্নগর্ভা। তিন কন্যার পর চতুর্থ পুত্র সন্তান ভূপেন্দ্রর জন্ম সংসারে বেশ আনন্দ নিয়ে এসেছিল। তৎকালীন পূর্ববাংলার নোয়াখালীর লতিবপুর মাইনর স্কুলে তাঁর পড়াশোনা শুরু। পরবর্তীতে দেশভাগোত্তর কালে ১৯৫৫ সালের ১২ জুলাই তাঁদের পরিবার সীমানা পারাপার করে পরিস্থিতির বশবর্তী হয়ে। সবমিলিয়ে আট ভাই-বোন৷ সংসারের লঙ্গরটানা সহজ কথা নয়! ভূপেন্দ্রর বিয়ে হয়েছিল হেমপ্রভার সঙ্গে। আসলে গৃহিণীর সাহচর্য তাঁকে উজ্জীবিত করেছিল। আন্তরিক স্নেহপ্রবণ হেমপ্রভা সংসারের রাশ নিজ হাতে ধরেছিলেন বলেই শিক্ষা, সামাজিক ও সংস্কৃত পরিমণ্ডলে সময় দিতে পেরেছিলেন তিনি। ছয় সন্তান — জ্যোতিপ্রকাশ ভৌমিক, বীথিকারেখা ভৌমিক, বাসবীরেখা ভৌমিক, মাধুরিকা ভৌমিক, দীপঙ্কর প্রকাশ ভৌমিক ও সর্বকনিষ্ঠ সৌমিত্র প্রকাশ ভৌমিক। প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক গুণাবলীর বিকাশেও তিনি সমান নজর দিয়েছিলেন। আজ তাঁরা প্রত্যেকেই সমাজের নানা ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। শুধু প্রতিষ্ঠিতই নয় বলা ভাল তাঁরা আমাদের অহংকার। আসলে বীজতলা! গাছের মতোই মানব সন্তানের বীজতলা ভাল হলে তার জীবন সুন্দর হতে বাধ্য৷ শ্রীরামকৃষ্ণ আশীর্বাদ করে তাঁর প্রিয়তম সুযোগ্য শিষ্য বিবেকানন্দকে বলেছিলেন — “পারলে একটা বটগাছ হোস!পথিক এসে ছায়া পাবে, শান্তি পাবে, যাবার সময় হয়তো একটা ডাল ভেঙে নিয়ে যাবে !কত পাখি বাসা বাঁধবে, মল-মূত্র ত্যাগ করে নোংরা করবে!কত লতা পরজীবীর মতো গজাবে তোকে ঘিরে! কিছু যায় আসে না!
বটগাছ বটগাছই… তার মহিমা একটা ডাল ভাঙলে কিছু কমে না, পাখির মল-মূত্রের নোংরাও কিছু মনে আসে না! ধ্বংস হয়ে গেলেও ইতিহাসের বুকে লেখা থাকে, এখানে একটি বটবৃক্ষ ছিল।" এই আশীর্বাদের নির্যাসটুকু তিনি সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন পরম মমতায়। সাধারণ অর্থে স্ব-বিরোধ মনে হতে পারে, মানুষ কীভাবে বটবৃক্ষ হবে! কিন্তু এর মর্মার্থ ধ্রুবসত্য৷ বটগাছের গুণসম্পন্ন মানুষ হতে পারে। অন্যের আশ্রয় ও প্রশ্রয় হতে পারা— এর যে সুখ তা শুধু জন্ম নিলেই হয় না, কর্ম দ্বারা অর্জন করতে হয়। আর তাই আজ এই সন্তানেরা হয়ে উঠেছে সমাজের আলো। লোকে বলে, ভাল মানুষ যেখানেই যায় আলো ছড়ায়। তিনি ও তাঁর সন্তানেরা সমাজের সেই আলো। উচ্চরক্তচাপ, মধুমেহ, কিডনি জনিত বৈকল্য তাঁকে না ফেরার দেশের নাগরিক করে তুলল৷ বেদনা রয়ে গেল, সব বেদনার উপসম হয় না। এমন একজন সামাজিক পৌরুষ, ব্যাকরণবিদ্, সমাজহিতৈষী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকের প্রকৃত মূল্যায়ন আগরতলার নাগরিকজন করতে পারলেন না। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের বইতে হবে।
পূর্ব-পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের অধিনস্ত নোয়াখালী ডিসট্রিক্টের মদনমোহন হিন্দি বিদ্যামন্দির থেকে ১৯৫০ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে যখন সীমানা পারাপার করে এপারে এলেন তখন তাঁর বয়স কুড়ি বা একুশের কাছাকাছি। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হয়ে আই.এ সম্পন্ন করলেন ১৯৬১ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করলেন ১৯৬৪ সালে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে সংস্কৃতে অনার্স করলেন ১৯৬৫ সালে। বি.টি করলেন ১৯৬৭ সালে। পরবর্তীতে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে একের পর এক ডিগ্রি অর্জন করা সহজ ছিল না। উচ্চশিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহই তাঁকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি এটাও বলার, সংস্কৃত ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। সংস্কৃত পড়া, পড়ানো ও চর্চা তাঁর জীবনের একটা বড় কালখণ্ড। পেশায় শিক্ষক ভূপেন্দ্র সংস্কৃত বিষয়ে ত্রিপুরায় অথরিটি সম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন। আজীবন সংস্কৃতের মনন ও চর্চার মধ্য দিয়ে আসলে বিষয়ের সেবা ও উন্নতিই তিনি করে গেছেন, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যখন সংস্কৃত ক্রমশ একটি মৃতপ্রায় ভাষা হয়ে উঠছে, বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা সংস্কৃত পড়তে আগ্রহ হারাচ্ছে। মহাবিদ্যালয় সমূহে সংস্কৃত বিভাগের আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর তখনও তিনি আশা হারাননি। হয়তো তিনি বিশ্বাস করতেন, পোস্টমডার্ণ আধুনিক ভারতীদের অতীতের কাছে একদিন ফিরতেই হবে। আর তখন সংস্কৃতের পুনরুজ্জীবন ঘটবেই। হোমিপ্যাথি কেনো তাঁর আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে খুব কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। হোমিওপ্যাথিতে ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও পিএইচডি করেছিলেন তিনি চন্ডীগড় থেকে। যা অনেকের কাছেই বিস্ময়! আরো বিস্ময় হল, হোমিওপ্যাথিতে এতকিছু করার পরেও তিনি কখনো প্রেকটিস করেননি। যদি করলেনই তাহলে তা সমাজের কাজে ব্যবহার করলেন না কেনো? কী ছিল এই রহস্যের মূলে? যা একটি বড়ো প্রশ্ন চিহ্ন।
কাব্যতীর্থ, ব্যাকরণতীর্থ, সাহিত্য বিনোদ, পুরানতীর্থ, বিদ্যালঙ্কার, গীতারত্ন, জ্যোতিরস্মর্ণাভ, স্মৃতিতীর্থ, পুরানরত্ন সহ বহু উপাধিতে ভূষিত ত্রিপুরার বরপুত্র ভূপেন্দ্র কুমার ভৌমিক। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল মাসিক বাইশ টাকা বেতনে ১৯৫২ সালে নোয়াখালীর দুর্গাপুর জুনিয়র হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকরির মধ্য দিয়ে। মনে রাখতে হবে, তখন কেউ মাধ্যমিক পাশ মানে সমাজে তার অবস্থান অনেক উঁচুতে। কারণ সেই সময়ের সামাজিক কাঠামোয় উচ্চশিক্ষিতের হার খুব কম ছিল। পারিবারিক টানাপোড়েন, আর্থিক সংকট, সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাব উচ্চশিক্ষার দরজা অবদি পৌঁছুতে মোটেই অনুকূল ছিল না। পরবর্তীতে সামাজিক শিক্ষাকর্মী হিসেবে বল্লবপুর ও বিশ্রামগঞ্জ সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্রে কাজ করেছেন। আরো পরে বিশালগড় হাইস্কুলে হেড পন্ডিত হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৩ নবচন্দ্র ইনস্টিটিউটে সহকারী শিক্ষক, উমাকান্ত একাডেমিতে সহকারী শিক্ষক, বিজয়কুমার গার্লস হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক এবং সর্বশেষ ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত শান্তিরবাজার স্থিত বাইখোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে কর্মজীবন সুনামের সঙ্গে অতিবাহিত করেছেন। বেশ রমণীয় কর্মজীবন বললে অত্যুক্তি করা হয় না।
সামাজিক শিক্ষা ও সমাজিক কাঠামোর বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এটি তাঁর জীবনের অন্যতম একটি দিক। সমাজের সেবাকে তিনি নিজের সেবা বলেই মনে করতেন। আগরতলার ইয়ুথ স্টার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ইন্দ্রনগর জগৎপুর এলাকার বিভিন্ন বিচার সভায় (গ্রাম বাংলায় যাকে বলে শালিশী সভা) বিচারক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন আগরতলা পুরসভার নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়াও ইন্দ্রনগর জগৎপুর নাগরিক উন্নয়ন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সম্পাদক ছিলেন। ইন্দ্রনগর জগৎপুর এলাকায় সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি, পাশাপাশি বিবেকানন্দ ক্লাব কোর্ডিনেশন কমিটিতে সক্রিয়ভাবে তিনি কাজ করেছেন। অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বই, নোট, অর্থ না নিয়ে পড়ানো সহ নানান সহায়তা বরাবর তিনি করে গেছেন। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কথা হয়তো লিখে শেষ হবার নয়, তাঁদের কথাই এই সমস্যাদীর্ণ সংকীর্ণ কূপমন্ডুকতার সময়ে আরো বেশি করে আমাদের চর্চা প্রয়োজন আধুনিক বলে দাবিদার এই সমাজ-মানুষের মানসিক চিন্তার পরিসর বৃদ্ধির কথা মনে রেখে। তবলা, সংগীত, বিভিন্ন স্বাদের বইয়ের বিপুল সংগ্রাহক, মহালয়ায় চণ্ডীপাঠ, নিঃসন্দেহে একাগ্র চিত্তের পাঠক, অবসর জীবনে কখনো কখনো ১৮-২০ ঘন্টা পড়ার মতো ঈর্ষণীয় ক্ষমতা করায়ত্ত ছিল তাঁর। একটা সময় ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত সংস্কৃত পাঠ্য ও গ্রামার বইয়ের লেখকও ছিলেন। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী, না দেখে আবৃত্তি করে বলতে পারতেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ প্রভৃতি। বাংলা ব্যাকরণে তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করতেই হয়। ব্যাকরণ নিয়ে ধারাবাহিক চর্চা তাঁর অধ্যাবসায়কে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ খুব সহজেই তিনি নির্ণয় করতে পারতেন। কবি পল্লব ভট্টাচার্য, পুত্র চিকিৎসক ড. দীপঙ্কর প্রকাশ ভৌমিক ও অমিতাভ চক্রবর্তীর কথায় ও অনুরোধে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন বাংলা প্রচলিত ব্যাকরণ গ্রন্থ সমূহের একটি মূল্যায়ন গ্রন্থ। যার মূল কথা হবে প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণের ক্রিটিক্যাল রিভিউ। এটা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী কাজ হতে পারত যদি তিনি শেষ করতে পারতেন। এটা তো ঠিক বিদ্যাসাগরের সময় থেকে চলে আসা দীর্ঘ কাল অতিক্রান্ত বয়সের ভারে ন্যুব্জ সেই বাংলা ব্যাকরণ কতটা স্থিতিশীল এই সময়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য? এই বিষয়ে যে প্রাসঙ্গিক চিন্তার অবকাশ রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সারাক্ষণ কর্মমুখর থাকতে পছন্দ করতেন। শিক্ষার্থীদের জন্য টেস্ট পেপার তৈরি করা, বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখা, এমনকি ১৯৮০ সালে জুন মাসের দাঙ্গার প্রেক্ষিতেও অন্যদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে ভূপেন্দ্রর বড়ো অবদান ছিল।
চোখের পড়া নয় তিনি পড়তেন মনের পড়া। প্রচুর বই কিনতেন বইমেলা ও নানান বইয়ের দোকান থেকে। বিভিন্ন বইপত্রে উল্লেখিত প্রশ্নের সহজ-সরল সমাধান চটজলদি দিতে পারতেন। সোনামুড়া নিবাসী পরবর্তীতে ১৯৮৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সংস্কৃত বিষয়ের অধ্যাপক ধীরেন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল মূলত সংস্কৃত বিষয়কে আশ্রয় করেই। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় তিনি বলছিলেন, বিপুল সহায়তা তাঁর থেকে পেয়েছেন। কখনো রাগতে দেখেননি। অবশ্য ছেলে সুচিকিৎসক ড. দীপঙ্কর প্রকাশ বলেছেন বাবা ভীষণ রাগী ছিলেন কিন্তু সহজে তিনি রাগতেন না। এটাও একটা চারিত্রিক দিক। “বিদ্যা দদাতি বিনয়ং” — এই যে বিনয় তা আসে বিদ্যা থেকে। অধ্যাপক ধীরেন্দ্র এই উদাহরণ দিয়ে প্রকৃতই বলেছেন, ভৌমিক পরিবার বিদ্বান ও বিনয়ী; আর তাই কথাটি এই পরিবারের উদ্দেশ্যে বলতে গিয়ে যথার্থ। এমন শিক্ষিত ও মনস্ক পরিবার সত্যিই আজকাল বিরল। বিভিন্ন সময়ের তাঁর সংগ্রহশালা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রচুর প্রচুর বই, বহু পুরনো বইপত্র, বিভিন্ন ভাষার বইপত্র এই সংগ্রহশালার গৌরব। কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করলে পাঠক সহজেই বইগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবেন। যেমন — ১) সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান ২) সুলভ শরৎ সমগ্র ৩) রসায়নের রসাল গল্প — অমরনাথ রায় ৪) কার্ল মার্কস জীবন ও চিন্তা — সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ ৫) বিষ্ণুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা ৬) সঙ্গীত পারিজাত — অহোবল পণ্ডিত ৭) বাংলা সাহিত্যের কথা — মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ৮) রামমোহন রচনাবলী ৯) নবীনচন্দ্র রচনাবলী ১০) আকাশ ও পৃথিবী — দেবদাস দাশগুপ্ত ১১) তেতাল্লিশ খণ্ডে মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত মহাভারতম (বিশ্ববাণী প্রকাশনী প্রকাশিত) ১২) কৃত্তিবাসী রামায়ণ ১৩) শিল্পের স্বরূপ — লিও টলস্টয় এর দ্বিজেন্দ্রলাল নাথকৃত অনুবাদ ১৪) বিশ্বকোষ ১৫) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ — শিবনাথ শাস্ত্রী ১৬) ভাষা চিন্তা — ড. হায়াৎ মাহমুদ ১৭) বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত — ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৮) বাংলা ছন্দ শিল্প ও ছন্দ চিন্তার অগ্রগতি — প্রবোধ চন্দ্র সেন ১৯) নূতন ছন্দ পরিক্রমা — প্রবোধ চন্দ্র সেন ২০) পরিতোষ ঠাকুর অনুদিত ও সম্পাদিত সামবেদ সংহিতা ২১) মানব সমাজ-প্রজাতি, জাতি, প্রগতি — মিখাইল পেস্ত্তর্খ ২২) রাজগী ত্রিপুরার সরকারী বাংলা ২৩) সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ — পরেশচন্দ্র মজুমদার ২৪) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পরিচয় — ড. শ্রীমন্তকুমার জানা ২৫) পুস্তিকা বই খাকি প্যান্ট গেরুয়া ঝান্ডা, হিন্দু দক্ষিণপন্থার পর্যালোচনা বই এটি ২৬) ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ২৭) শ্রী অমিয় নিমাই চরিত — শিশির কুমার ঘোষ ২৮) মাতৃভাষায় শিক্ষার পদ্ধতি। — এই বইগুলোর নাম এইজন্য উল্লেখ করলাম এর থেকে পাঠক তাঁর পাঠ রুচির পরিচয় পাবে। বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, পাশ্চাত্য সবকিছুতেই তাঁর সমান পড়াশোনা ছিল। আসলে বিজ্ঞান চেতনা যেকোনো ভাষার যেকোনো লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সংগ্রহশালা বা ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার যে নামেই উল্লেখ করিনা কেনো তাতে প্রচুর বিজ্ঞান বিষয়ক বইপত্রও ছিল, এর মানে এটাই যে তিনি পছন্দ করতেন, পড়তেন। ব্যাকরণের নানা বিষয় নিয়ে নিরন্তর নিরীক্ষা করতেন, বানান নিয়ে কাটাছেঁড়া করতেন। নতুন কিছু করা, নতুন করে বলা এই-যে পরিবেশন রীতিগত শিল্পবোধ এটা তাঁকে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চিহ্নিত করে।
তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রীমান দীপঙ্কর প্রকাশের সৌজন্যে জানতে পেরেছিলাম, যখন বাংলা নিয়ে উচ্চশিক্ষা শুরু করলেন ভূপেন্দ্র কুমার ভৌমিক তখন কয়েকজন বন্ধু মিলে গ্রুপ স্টাডি করতেন। আগেকার দিনে একান্নবর্তী পরিবারে এরকম পড়াশোনার চল ছিল। একই পরিবারের দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। ফলত উঁচু ক্লাসের জন ছোট ক্লাসের যে তাকে অনায়াসে পড়িয়ে নিতে পারত। তখনও গৃহশিক্ষকের চল ছিল না! তাঁদের গ্রুপ স্ট্যাডিতে আসতেন মনমোহন ঘোষ, চুনীলাল গোস্বামী সহ আরো দু-চার জন। পরে অবশ্য সকলেই নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আসলে প্রকৃত সৎ ব্যক্তির সাহায্যের অভাব হয় না। বহুবছর পূর্বে ভূপেন্দ্র একবার পুজোর চাঁদা, মণ্ডপের বাঁশ ইত্যাদি নানান বিষয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়লেন এবং শারীরিক নিগ্রহের শিকারও হয়েছিলেন। ঘটনাটি শুনলেন তৎকালীন ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী দেবেন্দ্র কিশোর চৌধুরী। শুনে ভীষণ খারাপ পেলেন এবং দ্রুততার সঙ্গে নিগ্রহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে প্রকৃত শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরো একটি চমৎকার ঘটনা ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে, একবার কোর্টে একটি অহেতুক মামলা হয়েছিল ভূপেন্দ্র ভৌমিকের নামে৷ যে থানায় মামলা হল ওই থানার পুলিশ অফিসার তাঁর ছাত্র। মামলাটি যখন কোর্টে গেল কোর্টের বিচারকও তাঁর ছাত্র। অতএব সমাজে তাঁর অবস্থান সহজেই অনুমেয়। তাঁর পুত্র ড. দীপঙ্কর প্রকাশ ভৌমিক ও বন্ধুরা মিলে একটি লিটল ম্যাগাজিন শুরু করেছিল। নাম ‘উদ্দীপন’। ১৯৮৫ সালের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে প্রথম আত্মপ্রকাশ। বেশ পাঁচ-ছয় বছর চলেছিল কাগজটি। ‘উদ্দীপন’ গোষ্ঠী কবিতার আসর করত বছরে একাধিকবার শরৎতের আসর, বর্ষার আসর এমন নানান নাম দিয়ে জিবি বাজারের গোলচক্করে। নয় নয় করেও সেকালের তাবৎ সব কবিরাই এই আসরে কম-বেশি কবিতা পাঠ করেছেন। অনেকসময় রাজনৈতিক দলের মুখর প্রচার জনিত একঘেয়েমি কাটাতেও তারা কবিতার আসর আয়োজন করতেন। ভূপেন্দ্র ভৌমিক প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন, তা বিভিন্ন সাময়িক পত্রে প্রকাশিতও হয়েছে। এই ‘উদ্দীপন’র একটি সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন ‘আমাদের একালা — সেকাল ও একাল’। আজকের দিনে যা লোকাল ফর ভোকাল। সেকালে মানুষ প্রচুর পড়ত। আর পড়ত বলেই পরিণমনও এতটা পুষ্ট ছিল। তখনকার ত্রিপুরায় সমাজকল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের অধিনে জন গ্রন্থাগার চলত বিভিন্ন এলাকায়, এলাবাসীর পাঠের স্বার্থে। আগরতলার এই ভৌমিক বাড়িতে ট্রাঙ্ক দিয়ে বই আসত। তিন-চার মাস পরে আবার ট্রাঙ্ক বদল হয়ে নতুন বই আসত। যতদূর জানা যায় তাঁদের এই গ্রন্থাগারের ৩০-৪০ জন নিয়মিত পাঠক ছিলেন, তা সেকালের প্রেক্ষিতে কম কথা নয়। আর তাই তাঁর ছয় সন্তান কখনো বীরচন্দ্র স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে কার্ড করেনি। এখান থেকেই বইপত্র পড়ত৷ অবশ্য তাঁর লাইব্রেরিতে কার্ড ছিল। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ যেন মুখস্থ। প্রশ্ন করলেই কোন খণ্ডের কোন অধ্যায়ে আছে তা অনায়াসে বলে দিতেন। তুলনামূলকভাবে লিটারেচার কম পড়তেন ঠিক, মূলত বেশি পড়তেন ভাষা, ভাষার ইতিহাস, ক্রমবিকাশ প্রভৃতি। আর এভাবেই জীবনভর মানুষটি সমাজকে দিয়ে গেলেন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে নিরবে ভূমিকা পালন করে গেলেন। যতবার দেখেছি খুব বিনয়ী, স্বভাবে শান্ত। চোখের দৃষ্টি ঠিকরে জ্ঞানের জ্যোতি প্রজ্জোলিত হতো। তিনি কীর্তিমান শিক্ষক ভূপেন্দ্র কুমার ভৌমিক। বহু মনস্ক শিক্ষার্থীর কাছে চিরদিনের জন্য একটি অবিস্মরণীয় নাম। যাঁর কোনো বিকল্প হয় না, যাঁর কোনো তুলনা চলে না। একটিই শব্দবন্ধ অতুলনীয়।
আরও পড়ুন...