"অনেক দিন শরণার্থী জীবন কাটাতে হয়েছিল।"
ড. নিতাই আচার্য
December 18, 2025
ককবরক ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাকরণবিদ, লেখক ড. নিতাই আচার্যের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সৌম্যদীপ দেব
সৌম্য: প্রথমেই জানতে চাই বাংলা আপনার মাতৃভাষা, ককবরক বলা চলে প্রতিবেশী ভাষা, তা সত্ত্বেও ককবরক নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা ও লেখালেখি করলেন। কেনো? কেনো মনে হয়েছিল যে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠবেন? প্রতিবেশী ভাষা কীভাবে পক্ষান্তরে আপনার মাতৃভাষা হয়ে উঠল?
নিতাই: আমাদের সময়ে ককবরক নিয়ে পড়াশোনা করার কোন ব্যবস্থাই ছিল না, পক্ষান্তরে স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ স্তর পর্যন্ত ককবরক নিয়ে পড়াশোনার পুরো পরিকাঠামোই গড়ে উঠেছে আমাদের হাত দিয়ে। ককবরক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, ব্যাকরণ ও অভিধান ইত্যাদি লিখতে লিখতেই এক সময় লেখক হয়ে উঠলাম। পরবর্তী সময়ে ককবরক মরফলজি নিয়ে গবেষণা করে 'ডক্টরেট'ও পেলাম। তবে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠব বলে কিছু করিনি, সবই করেছি প্রয়োজনের তাগিদে। এখন হয়তো আপনাদের কাছে ব্যতিক্রমী মনে হচ্ছে। শৈশব থেকেই ককবরক পরিমণ্ডলে বড় হওয়া, কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ককবরক পড়ানো, বলা ও লেখার জন্যই ককবরক আমার কাছে মাতৃভাষার মতো হয়ে উঠেছে।
সৌম্য: দৌলত আহাম্মদ ও মাহাম্মদ উম্মর লিখলেন 'ককবরমা', ১৯০০ সালে রাধামোহন ঠাকুর লিখলেন 'ককবরকমা' ও আরো পরবর্তী সময়ে দশরথ দেব ১৯৭৭ সালে 'ককবরক ছীরীঙ' প্রকাশের মধ্য দিয়ে ককবরক ভাষা ও সাহিত্য নিঃসন্দেহে আরো অগ্রগতি লাভ করেছিল। ১৯৮৪ সালে আপনার প্রথম ককবরক ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ। এই প্রকাশের পথ কতটা সহজতর ছিল?
নিতাই: আমার লেখা ককবরকের প্রথম ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের পথ অনেকটাই সহজতর ছিল। কারণ চতুর্থ শ্রেণীর জন্য উক্ত বইটি লেখার আগে ১৯৭৯ সালে 'কগবরকমানি য়াপরি' নামে আমি একটি ককবরক ব্যাকরণ লিখেছিলাম যার পাণ্ডুলিপি দেখে দশরথ দেব আমাকে ককবরকের প্রথম ব্যাকরণ পাঠ্যবইটি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশ করেছিল শিক্ষাদপ্তর।
সৌম্য: বিভিন্ন জায়গায় সুদীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়েছেন। বহু অভিজ্ঞতা আপনার ঝুলিতে। তবুও এটা তো সত্যি যোগ্যজন প্রায় সর্বত্রই ব্রাত্য থাকেন। আপনার ক্ষেত্রেও তো এমন ঘটেছে। তবুও কাজই জীবনের ইতিহাস লিখে রাখে। কী বলবেন?
নিতাই: তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক রচনা (৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত একটি করে আমার কবিতা পাঠ্য ছিল), বেসিক ট্রেনিং কলেজে ককবরক শিক্ষকদের ককবরক প্রশিক্ষণ দেওয়া, আকাশবাণীতে ক্যাজুয়েল ককবরক এনাউন্সার হিসেবে কাজ করা, এডিসি'র বিভিন্ন ককবরক ওয়ার্কশপে কাজ করা, টি. আর. আই-এ সরকারী কর্মচারীদের ককবরক শিক্ষা দেওয়া, ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচারার হিসেবে ককবরক পড়ানো ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। দীর্ঘদিন ককবরক অ্যাডভাইজারী বোর্ডের সদস্যও ছিলাম। আবার ২০০০-২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী মহোদয়দের গৃহ শিক্ষক হিসেবে ককবরক শিখতেও সাহায্য করতে হয়েছিল। কাজেই ব্রাত্য ছিলাম বলে কখনো আমার মনে হয়নি। তবে ককবরকের প্রায় সর্বত্র আমার বিচরণে ঈর্ষাকাতর জনেরা মাঝে মাঝে ব্রাত্য রাখার চেষ্টা করেছেন এবং কখনো বা সফলও হয়েছেন।
সৌম্য: মূলত ককবরক ভাষা ও ব্যাকরণে বেশিরভাগ কাজ করেছেন আপনি। ককবরক ভাষার উপর যতটা বিশ্লেষণ হয়েছে, সাহিত্যে বিশ্লেষণের জায়গাটি আজও বেশ ক্ষীণ। কেনো? ককবরক ভাষায় রচিত সাহিত্য বহুলাংশে অমূল্যায়িত থাকার কারণটি কী? ককবরক সাহিত্যের বিশ্লেষক অপ্রতুল?
নিতাই: ককবরক ভাষার তুলনায় সাহিত্যে বিশ্লেষণের জায়গাটি সত্যি আজও বেশ ক্ষীণ। আমার যতটুক মনে পড়ে কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরী, শ্রীযুক্ত নরেশ চন্দ্র দেববর্মা ও ড. নির্মল দাস ককবরক সাহিত্য নিয়ে কিছু বিশ্লেষণাত্মক কাজ করেছেন। আমার 'প্রসঙ্গ ককবরক' বইটিতেও সাহিত্য নিয়ে বড় একটি প্রবন্ধ রয়েছে। ককবরক সাহিত্যের বিশ্লেষক অপ্রতুল বলেই ককবরকে রচিত সাহিত্য বহুলাংশেই অমূল্যায়িত রয়ে গেছে।
সৌম্য: ককবরক ভাষার পাঠক পরিধি ও প্রকাশনার সহজলভ্যতা কতটা রয়েছে? ককবরক ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বই প্রকাশ করতে গিয়ে কতটা সংকট অনুভব করেন?
নিতাই: সীসার অক্ষর একটি একটি করে নিয়ে হাতে কম্পোজ, নিউজপ্রিন্ট ভিজিয়ে পা দিয়ে চেপে চেপে প্রুফ আর পা-চালিত মেশিনে ছাপিয়ে আমার বই প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে। সেই তুলনায় এখন আগরতলায় ছাপা ও বাঁধাই যেমন উন্নত হয়েছে তেমনি ককবরক বইয়ের জন্য প্রকাশকও পাওয়া যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ককবরক পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ: বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন ক্রেতা ও পাঠক আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সিলেবাসভিত্তিক বই ছাড়া ককবরক ভাষা ও সাহিত্যের পাঠক ও ক্রেতা এখনও খুবই কম। এটাই প্রধান সংকট। তাবে এখন টি. আর. আই, ককবরক ডাইরেক্টরেট ও এডিসি ককবরক বই প্রকাশে উদ্যোগী হওয়ায় অনেকের লেখাই এখন পুস্তকাকারে প্রকাশিত হচ্ছে।
সৌম্য: এবারে অন্য একটি প্রশ্ন, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কতটা এগিয়ে আসছে আগ্রহী হয়ে এবং এই ভাষা নিয়ে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কী কী সুযোগ রয়েছে সংক্ষেপে একটু বলুন?
নিতাই: নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগের তুলনায় অনেকটাই আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসছে, অনেকের লেখা প্রকাশিতও হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকেই ককবরকে উচ্চ শিক্ষার পথ চলা শুরু হয়েছে, ককবরকে এম. এ. করে বেশ কয়েকজনই এখন পি. এইচ. ডি করছে। ককবরক নিয়ে পড়াশোনা করে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে যেমন কর্ম সংস্থানের সুযোগ রয়েছে তেমনি আকাশবাণী, দূরদর্শন এবং রাজ্য সরকার ও এডিসি'র বিভিন্ন দপ্তরেও ককবরক সংশ্লিষ্ট পদে কর্মসংস্থানের সুযোগ বর্তমান। কলেজে এস. সি'র জন্য সংরক্ষিত এসি, প্রফেসরের পদগুলো এখনো খালি পড়ে আছে।
সৌম্য: নিতাই আচার্যের চোখে ত্রিপুরার পাহাড়ি ও সমতল জীবনের মধ্যেকার দূরত্বের রেখাটি কী যা নাগরিক চোখে ধরা পড়ে না? কোথায় বিভাজন চিহ্নটি আরো জোরালো হলো?
নিতাই: অনগ্রসর আর অগ্রসর-এর মধ্যে দূরত্ব যতটুকু এক সময়ে পাহাড়ি ও সমতল জীবনের মধ্যেকার দূরত্বও ততটুকুই ছিল। এখন এই দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে। আর বিভাজন চিহ্ন বলে আগে কিছু ছিল না, তবে আশির দাঙ্গার সময় থেকেই একটা বিভাজন চিহ্ন তৈরি হয়েছিল যা ক্রমশ: দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সৌম্য: আপনি ১৯৮০ সালের দাঙ্গার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। উগ্রবাদীদের মুক্তাঞ্চলে আপনার গ্রামীণ বসতি ছিল বলা যায়। কেনো এতটা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল এই দাঙ্গা? সংকটটি কোথায় তৈরি হয়েছিল- আপনার ব্যক্তিগত অনুভব জানতে চাই।
নিতাই: ১৯৮০ সালের দাঙ্গায়ই আমরা বাড়িঘরসহ সর্বস্ব হারিয়ে আমার প্রিয় গ্রাম, খোয়াই মহকুমার আমপুরা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। অনেক দিন শরণার্থী জীবন কাটাতে হয়েছিল। ককবরক ছাড়া ওখান থেকে আর কিছুই আনতে পারিনি। স্বাধীন ত্রিপুরার স্বপ্ন সাকার করার উদ্দেশ্যেই এই দাঙ্গা এমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। সাম্প্রদায়িক উসকানি ও রাজনৈতিক ইন্ধনই এই সংকটের মূল বলে আমার ধারণা।
সৌম্য: 'চিনি বরক' কথাটি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
নিতাই: 'চিনি বরক' কথাটির অর্থ হলো 'আমাদের লোক'। ককবরকভাষীরা আমাদের তুলনায় নিজেদের লোকজন সম্পর্কে অনেক বেশী সচেতন। নিজেদের লোকজন সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া বা কিছু বলার সময় তাঁরা এই কথাটি ব্যবহার করে থাকেন।
সৌম্য: 'ছড়া ও ছন্দে ককবরক শিক্ষা'- এমন বই লিখলেন, ব্যতিক্রমী নান্দনিক কবিতা তো বটেই, ব্যাকরণের এহেন কাব্যিক প্রকাশ পূর্বে আর দেখা যায়নি তা স্বীকার করতেই হবে। এই সৃষ্টির জিজ্ঞাসা কেনো তৈরি হয়েছিল আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি বলেন?
নিতাই: শুধু শিশুদের কাছেই নয়, ছোট-বড় সবার কাছেই ছড়া ও ছন্দের আবেদন চিরন্তন। ছড়া ও ছন্দের তালে তালে কোন কিছু আয়ত্ত করলে তা মনের মধ্যে গেথে থাকে। ২০০৪ সালে বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম ও ক্রিয়াবাচক শব্দ শেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি ছড়া লিখে ক্লাসে এগুলো পড়িয়ে দেখলাম শিক্ষার্থীরা শব্দগুলো সহজেই মনে রাখতে পারছে। আর ভুলে গেলেও ছড়াগুলো ছন্দে ও তালে বলে বলে মনে করতে পারছে। তারপরই প্রকাশিত হয় 'ছড়া ও ছন্দে ককবরক শিক্ষা'।
সৌম্য: ১৯৮৬ সালে 'য়াখরাই' নামে ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগজিন সম্পাদনা করেছেন এবং ছয়-সাতটি সংখ্যা প্রকাশিতও হয়েছিল। কেনো বন্ধ হয়েছিল? আবার নতুন করে প্রকাশের পরিকল্পনা কি আছে?
নিতাই: আমার আগে বা পরে সবাই ককবরক লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন সমষ্টিগতভাবে, আর আমি একাই 'য়াখরাই' সম্পাদনা ও প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানে ককবরক পড়ানো ও লেখালেখির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ম্যাগাজিনটি আর চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এখন আর নতুন করে প্রকাশের কোন পরিকল্পনা নেই।
সৌম্য: সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার সুখ। নতুন কী কী লিখছেন?
নিতাই: আগে লিখতাম প্রয়োজনের তাগিদে, এখন লিখি সৃষ্টি-সুখের আনন্দে। হাতে করোনার সময়ে ককবরকে অনূদিত পাঁচটি পাণ্ডুলিপি আছে। কিছু দিনের মধ্যেই প্রকাশিত হবে 'অতি সহজ ককবরক শিক্ষা'। এখন লিখছি 'চলো শিখি পাশাপাশি বাংলা ইংরাজি ককবরক'। আর পূর্বে প্রকাশিত 'ককবরক মাধ্যমে বাংলা ভাষা শিক্ষা', ইংরাজি মাধ্যমে 'An Easy Kokborok Primer' ও ককবরক মাধ্যমে 'Lets Learn English Through Kokborok' বই তিনটি সংস্কার করছি পুনর্মুদ্রণের জন্য।
আরও পড়ুন...