উপজাতিয় জনপদে বাড়ছে ক্ষুধা, জুমিয়াদের অর্থের হরির লুট
প্রদীপ চক্রবর্তী
রাজ্যে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতিয়দের কাছে সরকারী সুযোগ-সুবিধাতো দূরের কথা তাদের কাছে চাল সহ রেশন সামগ্রী আজো পৌছেনি। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে অভাব তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এদের অভাব এমন তীব্রতর যে তাদের পক্ষে এরজন্য তদ্বির তদারকি করাও সম্ভব হচ্ছে না। কেননা এরা যানবাহনের অভাবে না যেতে পারছেন ব্লক অফিসে, না পারছেন মহকুমা শাসক অফিসে। অভাবের তীব্রতা এত বেশী যে অধিকাংশ উপজাতিয় পরিবার একবেলাও মুখে কিছু দিতেই পারছেন না। এদের সন্তান সন্ততিরা বহু ক্ষেত্রেই ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠছেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার রোধে লকডাউন জনিত কারনে এদের অভাব আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন জুমিয়ারা। রাজ্যে জুমিয়া পরিবারের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। এদের না আছে রেশন না আছে সরকারী কাজ বিশেষ করে রেগার কাজ। রাজ্যের উপজাতিয় কল্যানমন্ত্রী মেবার কুমার জমাতিয়া নিজেই জুমিয়াদের কর্মহীনতার কথা স্বীকার করে বলেছেন বহু জুমিয়া পরিবারের রেশন কার্ড নেই।
মেবার কুমার জমাতিয়া বলেছেন যে এদের সমস্যা মো কাবেলায় সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। জুমিয়াদের যেমন মাথাপিছু একহাজার টাকা দেওয়া হবে তেমনি এদের জুম চাষের জন্য বীজ ও দেওয়া হবে।
এখন জুমে আগুন দেওয়ার সময়। আগুন দেওয়ার পরই রোপনের সময়। আঠারো মুড়া, লংতড়াই, বড়মুড়া, শাখান, লঙ্গাই,দেবতামুড়া পাহাড়ে যারা জুম করে থাকেন তারা টং করে আগুনও দিয়েছেন। এখন অল্পস্বল্প বৃষ্টি হচ্ছে, মাটি ভিজেছে, বীজ পেলেই শুরু করবে রোপনের কাজ। কিন্তু বীজতো ওদের কাছে নেই। রোপন করবে কিভাবে এরা? অথচ জুমিয়াদের কাছে এই সময় অন্ন সংস্হানের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। জুমিয়াদের কাছে কিন্তু মহাজনরা বরাবরই আর্থিক প্রশ্নে বড় ভূমিকা নিয়ে আসছে। সরকার বা এডিসির বাস্তব অনুপস্থিতিতে মহাজনরা জুমিয়াদের আগেও যেমন সুদে টাকা দিয়েছে এবারো তারা মুখিয়ে আছে বলেই খবর। মহাজনরা সাধারণত এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে ।এটা আজকের নয়, বছরের পর বছর ধরেই এই মহাজনী ব্যবসা চলে আসছে। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা জুমিয়াদের সমস্যা আরো জটিল করে তুলছে। রাজ্যের এমন অসংখ্য উপজাতিয় পরিবার রয়েছে যারা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করেন তাদের কাছে প্রশাসন আদৌ পৌছে না বলে অভিযোগ। অভিযোগ এদের জন্য বরাদ্দ নানা প্রকল্পের অর্থ রেগা মাষ্টার, পঞ্চায়েত সচিব, ভিলেজ এসিন্টেন্সরা গায়েব করে দিয়ে থাকেন। তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থেই এরা জেলা সদর বা রাজধানীতে অট্টালিকা হাঁকিয়েছেন।
এখন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে লকডাউন থাকায় রাজ্য সরকার এদের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প তেমন ঘোষণা করেছে তেমনি আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছে। সেদিনও উপজাতি কল্যানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিপূর্বে মুখ্যমন্ত্রীও ঘোষনা করেছেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা যাদের জন্য এই সব ঘোষনা তাদের বড় অংশ যেমন জানেন না তেমনি সুফল পায়নি।
প্রসঙ্গত বলা বাহুল্য করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাক্স ব্যবহার,সেনিটাইজার দিয়ে হাত ধোঁয়া সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এদের যেমন জানানো হয়নি তেমনি সচেতনতা ও সৃষ্টি করা হয়নি। হয়নি ছাপানো প্রচার পুস্তিকা বা পোষ্টার। অন্তত কমপুই, খানত্লাং, মানিকপুর, গোবিন্দবাড়ী, রাজধর, মালিধর, মানিক্য দেয়ান, করবুক, শিলাছড়ি অঞ্চলে এসব লোকজন দেখেনি। যদি করোনা সংক্রমন উপজাতিয় অঞ্চলে শুরু হয় তাহলে মহা বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। হয়তো সরকারী নথীতে প্রচারনার জন্যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, কাগজে কলমে ছাপানোও হয়েছে বাস্তবে কিন্তু সব ধূ ধূ। আশা কর্মীদের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তাদের অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মত। অথচ আশা কর্মীদের এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা।
বলা হচ্ছে জুমিয়াদের হতভাগা জীবনের বারমাস্যার কথা।এই সময়েই এরা এক টিলা থেকে আরেক টিলা, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ঘর বাঁধে। বাঁশ, ছন দিয়ে টং ঘড় করে সেখানে পরিবার নিয়ে কয়েক মাসের জন্য বসবাস করেন। সেখানে থেকেই জুম করেন। এবছর এ পাহাড় তো আগামী বছর আরেক পাহাড়ে থাকেন। তাদের রেশন কার্ড নেই,নেই হয় আঁধার। ব্যাঙ্কের একাউন্ট কাকে বলে এটাও ওরা জানেনা। তো এদের কাছে সরকারী অর্থ পৌঁছবে কি করে? গ্রাম্য টাউট বাটপাররা এদের অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে ,আর ওই নিঃস্ব অসহায় জুমিয়ারা আরো অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকার একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে জুমিয়াদের যাযাবর অর্থাৎ ভেসে বেড়ানোর জীবনের অবসান করা হবে। এদের পাকা ঘর তৈরীর করে দেওয়া হবে। যথারীতি ব্লকগুলিকে অর্থ দেওয়া হয়। ঘর নির্মাণের জন্য ঠিকেদারদের বরাত দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্মাণ কাজ শুরুও হয়। তারপর ঠিকেদাররা কাজ মাঝখানে অসমাপ্ত রেখে সুপারভাইজারদের সহযোগে বরাদ্দ অর্থ গায়েব করে দেন। ইন্দিরা আবাস যোজনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বলা চলে বা অভিযোগ ৭০ শতাংশ আবাস যোজনার অর্থ গায়েব হয়ে গেছে। আর জুমিয়ারা নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে চলেছে। এদের ভাগ্যের আকাশ আলোকিত হবে কিনা তা বলবে সময়।
তবে পাহাড়ে কিন্তু অভাব বাড়ছেই। জুমিয়ারা আরো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সরকারের আশু কর্তব্য প্রশাসনকে গ্রামস্তর বিশেষ করে পাহাড়ের মহল্লায় নিয়ে যাওয়া।