সরকারি ঘোষণা আর বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক অনেকক্ষেত্রেই
পুরুষোত্তম রায় বর্মন
সরকারি ঘোষণা আর বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক অনেক ক্ষেত্রেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রায় একমাস পূর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে, দেশে প্রত্যেক গরীব পরিবার এক কিলো ডাল পাবে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা মতে ১৯ কোটি পরিবারের মধ্যে এক কোটি ৯৬ লক্ষ টন ডাল বিতড়িত হওয়ার কথা। আজকে দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এখন অব্দি মাত্র ৩০ হাজার টন ডাল বিতড়িত হয়েছে। এই খবরের সূত্র কেন্দ্রীয় ক্রেতা স্বার্থ দপ্তরের প্রদত্ত তথ্য। একই অবস্থা অন্যা সব প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রায় দু সপ্তাহ পূর্বে জানানো হয়েছিল যে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আট হাজারের উপর রিক্সা শ্রমিককে ১০০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। এই খবর শুনে স্বাভাবিকভাবেই আমরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম, রোজগার বঞ্চিত রিক্সা শ্রমিকদের হাতে কিছু নগদ জুটবে এইভেবে এবং স্বাভাবিকভাবেই সরকারের অনেক কাজকর্মের সমালোচনা করলেও এই পদক্ষেপকে তারিফ জানিয়েছিলাম। কিন্তু ত্রাণকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। অনেক রিক্সা শ্রমিকের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছি তারা ১০০০ টাকা পেয়েছেন কিনা। কেউই কিন্তু বলেননি টাকা পেয়েছেন। সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখনো ১০০০ টাকা করে রিক্সা শ্রমিকদের দেওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি চলছে। গতকালের হিন্দু পত্রিকায় তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায় দিল্লিতে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ৬৫% এর কাছে এখনো অব্দি কোন সরকারি সাহায্য পৌঁছয়নি। ৬৫ শতাংশ শ্রমিক না পেয়েছেন শুকনো রেশন , না পেয়েছেন রান্না করা খাবার। তাদের হাতে নগদ পয়সাও নেই । এই সমীক্ষা থেকেই বুঝা যায় দিল্লিতে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকাংশই অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছেন। এটা শুধু দিল্লির ছবি নয় সারাদেশেরই ছবি বলা যায়। ত্রিপুরাতে ত্রাণকার্যে অংশ নিয়ে আমাদের উপলব্ধি গরিব মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকারের তরফে ব্যাপক উদ্যোগ একান্তভাবে জরুরী।
শুধু ত্রাণ দিয়ে এই সমস্যার মোকাবেলা করা সম্ভবপর নয়। তাই বলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমরা যেমন মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব তেমনি সরকারের উপর আমাদের চাপ তৈরি করতে হবে গরীব মানুষের খাদ্যের অধিকার , বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য । আজকে কমলপুরের একটি গ্রামে যুক্তিবাদী সমিতির কর্মীরা ও মানবাধিকার কর্মীরা দুলাল ঘোষ ও তার সতীর্থদের উদ্যোগে ত্রাণ বিলি করেছেন। এই প্রসঙ্গে দুলাল ঘোষ একটি পোস্টে সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে , গরিব মানুষের খাদ্যের সংস্থান করার দায়িত্ব একমাত্র সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যেই সম্ভব। এটা বাস্তব কথা। রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন গরিব মানুষকে দুবেলা খেতে দিতে বিশেষ খরচ হবে না সরকারের । পাশাপাশি সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকার ভার গ্রহণ করা। রঘুরাম রাজন আরো বলেছেন রাজকোষ ঘাটতির কথা ভাবলে চলবে না, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গরিব লোক যাতে দুবেলা খেতে পায়, তারা যাতে সুস্থ থাকে, সেটা সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে এবং এটা করার সামর্থ্য সরকারের আছে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছেন। সম্পদশালীদের উপর কর আরোপ করেও সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান করতে পারে। এটা যদি সরকার না করে তাহলে আগামী দিনে লকডাউন ওঠার পরেও পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। করোনা মহামারী একদিকে স্বাস্থ্য সংকট অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকটের সামনে ভারতসহ সারা বিশ্বকে দাঁড় করিয়েছে। এদুটো সংকট মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সঠিক রাষ্ট্রীয় নীতি এবং উদ্যোগ প্রয়োজন। এই সংকটের মোকাবেলা বাজার অর্থনীতি করতে পারবে না। করতে হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে।
আজকে আমরা বামুটিয়ার তালতলাতে ৪৫ জন দুঃস্থ মানুষের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়েছি । স্থানীয় যুবকরা সুন্দর ব্যবস্থাপনা করেছিল। যাদের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়েছি তাদের অধিকাংশই চা শ্রমিক। তাদের সাথে কথা বলে জানলাম অনেকেরই রেশন কার্ড নেই । যাদের আছে তারা যা পেয়েছেন তাতে বড়জোর এক সপ্তাহ কিন্তু দু সপ্তাহের খোড়াক জোগাড় হয়েছে। বাকি মাস তারা কী করবেন । সবারই মুখে চোখে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার ছাপ। লকডাউন উঠলে পরেও কি হবে এ নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। একইভাবে আমরা বামুটিয়া বাজার সংলগ্ন নামাবাড়ীতে ৫০ জনের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিলি করেছি। এলাকাটি মিশ্র এলাকা। এখানে মণিপুরীরা আছেন। বাঙালিরা আছেন । ইটভাটার শ্রমিকরা আছেন। আমরা যেখানে ত্রাণ বিলি করছিলাম তার সামনেই একটি ইটভাটা রয়েছে। স্থানীয় যুবকরা জানালো, গতকাল প্রশাসনের তরফ থেকে ইটভাটা শ্রমিকদের সাহায্য দেওয়া হয়েছে। নামাবাড়ী নামের মাহাত্ম্য স্থানীয় যুবকরা ব্যাখ্যা করে দিল। এই জায়গাটা নিচু তাই নাম হয়েছে নামাবাড়ী। সত্যিই জায়গাটা নিচু। আগে বর্ষার সময় যখন এদিকে আসতাম তখন এ জায়গাটা প্রায়ই জলের নিচে থাকতো। এখানে আমরা ৫০ জনকে ত্রাণ সামগ্রী তুলে দিলাম। দু'জায়গাতেই মাথাপিছু 4 কিলো চাল, দু কিলো আলু , ৭৫০ গ্রাম মসুর ডাল ও ৭৫০ গ্রাম সোয়াবিন। এলাকার যুবকরা দুঃস্থ মানুষদের তালিকা তৈরি করে রেখেছিল। ত্রাণ বিতরণের সময় স্থানীয় পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানের সামনেই অনেকে জানালেন এখন অব্দি আমরা কিছুই পাইনি । কি করে চলবে আমাদের। ধর্মনগরের নদিয়াপুরের শনি ছড়ায় ৪০ জনকে ত্রাণ সামগ্রী তুলে দিতে পেরেছি স্থানীয়দের যুবকদের সহায়তায়। এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন মনোজ সিং ও তার বন্ধুরা। শনিছড়ায় প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে তিন কিলো চাল, দু কিলো আলু, ৫০০ গ্রাম সরিষার তেল,৫০০ গ্রাম মসুর ডাল ও ৫০০ গ্রাম সোয়াবিন।