নতুন শ্রম আইন: শ্রমিক সমাজ কীভাবে উপকৃত হবে এবং এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সমূহ
জয়ন্ত দেবনাথ
December 1, 2025
ভারত সরকারের প্রণীত চারটি নতুন শ্রম আইন যা ২৯টি পুরনো শ্রম আইনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে,
তা দেশের শ্রম ব্যবস্থায় স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় সংস্কার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। গত ১১ নভেম্বর ২০২৫ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই নতুন শ্রম আইন চালু হয়েছে। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গুলো ছাড়া দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন গুলোর তরফে এখন পর্যন্ত নতুন শ্রম আইন নিয়ে কোথাও বড় আকারের আন্দোলন ও বিরোধিতার খবর নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবী অনুযায়ী, শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মস্থলে সুপরিবেশ ও সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি 'ইজ অব ডযিং বিজনেস' বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই নতুন শ্রম আইন চালু করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু শিল্প বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, এই নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিক সমাজ যেমন কিছু উপকার পাবেন, তেমনি এর প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এই প্রতিবেদনে খুব সহজে নতুন শ্রম আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সমূহ গুলোর উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
নতুন শ্রম আইন থেকে শ্রমিক সমাজ কীভাবে উপকৃত হতে পারে? নতুন শ্রম আইনে বলা আছে, সোশ্যাল সিকিউরিটি কোড অনুযায়ী এখন স্থায়ী কর্মচারী ছাড়াও প্ল্যাটফর্ম কর্মী, চা বাগানের শ্রমিক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে কাজ করা শ্রমিকরাও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় এসেছে। এর ফলে পিএফ, বীমা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ইত্যাদি সুবিধা সব শ্রমিকরাই পাবে। তবে কিভাবে, কার মাধ্যমে অস্থায়ী শ্রমিকদের এই সুবিধা নিশ্চিত করা হবে তা রাজ্য সরকার গুলিকে ঠিক করতে হবে।
নতুন শ্রম আইনে
কর্মক্ষেত্রে শ্রম বিরোধ ও অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হয়েছে। এজন্য ২০ জনের বেশি কর্মী থাকা প্রতিষ্ঠানে গ্রিভেন্স রিড্রেসাল কমিটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। থাকতে হবে মহিলাদের জন্য পৃথক রিড্রেসাল কমিটি। এতে শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রের যেকোনো সমস্যা সময়মতো তুলে ধরে সমাধান পেতে পারবেন।
নতুন মজুরি কোড অনুযায়ী যেকোন শ্রমিকের বেসিক বেতন, মোট বেতনের কমপক্ষে ৫০% হতে হবে। এতে পিএফ সহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় বাড়বে, যা ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
নতুন শ্রম আইনে শ্রমিকদের
স্বাস্থ্য, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ আরও উন্নত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষত, খনি, নির্মাণ, কারখানা, এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শ্রমিকদের বিশ্রাম, কাজের ঘণ্টা, প্রাথমিক চিকিৎসা
ইত্যাদির উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
যেকোন ধরনের
চুক্তি ভিত্তিক কর্মী, প্ল্যাটফর্ম কর্মী, ডেলিভারি কর্মী, ড্রাইভার, অনলাইন সেবা প্রদানকারী কর্মীরা এখন থেকে শ্রম আইন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, যা তাদের ভবিষ্যৎ পেনশন সহ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। আর এজন্য আগের ২৯টি আলাদা আলাদা শ্রম আইন বাদ দিয়ে মাত্র ৪টি কোড করা হয়েছে। এতে শ্রমিকদের নিজেদের অধিকার গুলো বুঝতে সুবিধা হবে এবং আইনগত জটিলতা অনেকটাই কমবে।
কিন্ত নতুন শ্রম আইন গুলো নিয়ে শ্রমিক সমাজে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ও বেশ কিছুদিন ধরে বামপন্থীদের তরফে এর কিছু নেতিবাচক দিক গণমাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। বামপন্থীদের নতুন শ্রম আইন চালুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী আপত্তি হল, শ্রমিকদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত হওয়ার ব্যাপারে। কেননা, নতুন শ্রম আইনে শ্রমিকদের অনুমোদন ক্রমে ওভার টাইম কাজে কোনও বাধা নেই। সপ্তাহে মোট ৪৮ ঘণ্টা কাজের শর্তে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গুলোর মতে, এটি অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং শ্রম শোষণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বামপন্থীদের আরও একটি আপত্তির জায়গা হল,
নতুন শ্রম আইনে সহজেই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সুযোগ রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিযেল রিলেশন কোড অনুযায়ী ১০০-এর বদলে ৩০০ জন কর্মী থাকা শিল্পে ছাঁটাই করতে শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আর আগের মতো অনুমতি নিতে হবে না। বামপন্থীদের মতে, এতে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা কমতে পারে। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গুলোর আরও অভিযোগ, শ্রমিকদের হাতে পাওয়া বেতনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। কারণ বেসিক বেতন বাড়ার ফলে পিএফ কর্তনও বাড়বে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে সঞ্চয় বৃদ্ধি হলেও মাসিক হাতে পাওয়া বেতন কমে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের কর্মীদের দৈনন্দিন ব্যয় সামলাতে সমস্যা হতে পারে।
বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন গুলোর আরও অভিযোগ, অস্থায়ী শ্রমিকদের ও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের জন্য নতুন শ্রম আইনে বিভিন্ন সুবিধা মিললেও বাস্তব সুবিধা যেমন, পেনশন, বীমা, ভাতা
এসব এখনো ভবিষ্যতের স্কিমের উপর নির্ভর করছে। এতে সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা কম।
বামপন্থীদের তরফে আরও যে একটি চিন্তা নতুন শ্রম আইনকে নিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে তা হল, দেশে
অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা। বামপন্থীদের আশঙ্কা, অনেক ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক ভাবে কর্মী নিয়োগ করতে আগ্রহ হারাতে পারে। এর ফলে বেশি শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক শ্রম বাজারে ঢুকে অধিকার বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
বামপন্থীদের আরও আশঙ্কা,
নতুন শ্রম আইনে
ধর্মঘট ও শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার সীমিত হবে। কেননা, নতুন শ্রম আইনে ধর্মঘটের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের নোটিস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের নিয়মও কঠোর করা হয়েছে। এতে শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যেতে পারে বলে বামপন্থী সমালোচকরা মনে করেন।
নতুন শ্রম আইন: গুরুত্বপূর্ণ মূল পয়েন্ট সমূহ
* চারটি প্রধান কোডে সমস্ত শ্রম আইন একত্রিত হয়েছে
1. Wage Code,
2. Social Security Code,
3. OSHWC Code and
4. Industrial Relations Code।
* ন্যূনতম মজুরি সারা দেশে সমানভাবে কার্যকর হবে। সব শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার অধিকারী।
* সময় মতো বেতন প্রদান বাধ্যতামূলক। তথ্য প্রযুক্তি সহ সব সেক্টরে মাসের ৭ তারিখের মধ্যে মজুরি প্রদান বাধ্যতামূলক।
* সমান কাজের জন্য সমান বেতন, নারী-পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
* স্থায়ী মেয়াদী কর্মসংস্থান (FTE), চুক্তিভিত্তিক কর্মীদেরও স্থায়ী কর্মীদের মতো সামাজিক নিরাপত্তা এবং ১ বছরের চাকরির পর গ্র্যাচুইটি প্রদান বাধ্যতামূলক।
* গিগ ও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের প্রথম বারের মতো স্বীকৃতি, এবং তাদের জন্য আলাদা কল্যাণ তহবিল গঠন (অ্যাগ্রিগেটরের টার্নওভারের ১–২%)।
* বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতকালে দুর্ঘটনাকেও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হবে।
* বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা বিনামূল্যে কোম্পানির দায়িত্বে করাতে হবে। খনি শ্রমিক, বিপজ্জনক কাজের শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির জন্য স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামূলক।
* রাতের শিফটে নারীদের কাজের অনুমতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যেকোনো সেক্টরে কাজ করানোর বিধান রয়েছে নতুন শ্রম আইনে।
* মাতৃত্বকালীন সুবিধা বৃদ্ধি করে ২৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বেতনভুক্ত ছুটি, ক্রেচ সুবিধা, বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ প্রদান করা হযেছে নতুন শ্রম আইনে।
* ওভারটাইমে দ্বিগুণ মজুরি প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন শ্রম আইনে।
* নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন শ্রম আইনে এবং প্রতিটি কর্মীকে চাকরির শুরুতেই নিয়োগপত্র দিতে হবে।
* কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে নতুন শ্রম আইনে
প্রতিদিন ৮–১২ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা, সারা দেশে একজন শ্রমিকের সম অধিকার লাঘু করা হয়েছে।
* শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলিতে নিরাপত্তা কমিটি, বিশেষত বিপজ্জনক শিল্পে বাধ্যতামূলক
রাসায়নিক ব্যবহারে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
* এমএসইমি সহ সব শিল্পে সমান সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা যেমন, পিএফ, ইএসআই, পেনশন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
* বকেয়া দাবি নিষ্পত্তির জন্য ৩ বছর পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছে।
* ডিজিটাল মিডিয়া, অডিও ভিজ্যুয়াল কর্মীদের আইনি স্বীকৃতি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হযেছে নতুন শ্রম আইনে।
* রপ্তানি শিল্পে নারীদের রাতের শিফটে কাজের সুযোগ প্রদান করে তাদের জন্য
নিরাপদ পরিবহন, সিকিউরিটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে,
নতুন শ্রম আইন গুলো একদিকে যেমন আধুনিক শ্রম ব্যবস্থার পথ দেখাচ্ছে, তেমনি অপরদিকে কিছু বাস্তব উদ্বেগ ও সমস্যা রয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিস্তৃত হওয়া, অসংখ্য অস্থায়ী শ্রমিকদের স্বীকৃতি পাওয়া, এবং শ্রম আইন সহজ হওয়া অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু চাকরির স্থায়িত্ব কমে যাওয়া, কাজের সময় বৃদ্ধি এবং রাজ্য স্তরে বাস্তবায়নের ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক দিক। তাই নতুন শ্রম আইনে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা ও সুবিধা দিতে হলে সরকারকে চাই কার্যকর বাস্তবায়ন, সর্বত্র শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা, এবং সময়োপযোগী সংশোধন। সঠিক প্রয়োগ হলে এই নতুন শ্রম কোড গুলো ভারতের শ্রম জগতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সংগত আধুনিক শ্রম ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামো তৈরি করতে পারে। ( লেখক জয়ন্ত দেবনাথ একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও ত্রিপুরাইনফো-র সম্পাদক)।
আরও পড়ুন...