ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে

শ্রীমতী রুক্ষিনী দেবী

November 19, 2025

গ্রামীণ কৃষি জীবনে আজও যেমন ভাবে মাঠে মাঠে ধানের শীষ (আগামীর ফসল) আসলে পরে শ্রীশ্রী মা লক্ষ্মীর সাধভক্ষণ বা গারই (অঞ্চল ভেদে বলা হয় গাঢ়ুই) ব্রত পালন করা হয়, এই প্রার্থনা সহযোগে~

“আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায়

যে বড় মাঙ্গে সেই বর পায়..”,

ঠিক তেমন ই ধান কাটার পরে আজও পালিত হয় গ্রামীণ কৃষি উৎসব ধানকাটি-নবান্ন বা লবান।

হেমন্তের দিগন্তবিস্তৃত সোনালি মাঠের সোনালি ফসল ঘরে তোলার পালা যখন শুরু হয় তখন ধানকাটার মরসুমে র শুরুতে, ঠিক আগের দিন শুভ মুহূর্তে হয় নানান পুজো, যা একবারেই বিশুদ্ধ গ্রামীণ আচার-উপাচার সমন্বিত।

বলা যায়, আজকের দিনে সে সব ই লুপ্তপ্রায় তথাপি মাটির সুঘ্রাণ মিশে থাকা নিগূঢ় নিবিড় গ্রামীণ কৃষি নির্ভর জীবনধারায় আজও তা তেমন ই প্রাসঙ্গিক।



কার্তিক সংক্রান্তিতিথিতে (পঞ্জিকা মতে কিছুদিন হয়তো বা আগে পরে) ধানের মুঠ বাসগৃহে আনেন কৃষকেরা, নবান্নের জন্য যে ধান লাগানো হয়, সেই জমি থেকেই মুঠ আনেন আড়াই গোছ ধান কেটে। এই মুঠ এনে অনেকে মুঠলক্ষ্মী পুজো করেন, অনেকে আবার ধানকাটি কার্তিক পূজা করেন।কার্তিক সংক্রান্তিতিথি তে এই ব্রতের সূচনা হয়, শেষ হয় অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে (নবান্নলক্ষ্মী পুজো বা নবান্ন উৎসব)।



কার্তিকের সরার সামনে লক্ষ্মীর ঘট ও মাটির সরা রেখে, তাতে রাখা হয় ধান,কচু, চালিতা ফল ও পাতা, ছোলা, মটর, চিড়া-গুড়, চাল কলা নৈবেদ্য, ছোলা-বাদাম, চানা-বুট ভাজা, আবার কোথাও কোথাও এই ব্রতের প্রধান ফুল হলো সরষের ফুল।

এই ব্রত পালনের পর ই অগ্রহায়ণের শুভ পূর্ণিমা তিথীতে নতুন ধানের নতুন চালে পালন করা হয় নবান্ন, জোড়া মন্ডা-মিঠাই, পীঠে-পুলি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি ভোগ নিবেদনের মাধ্যমে।

লৌকিক মতে দেবসেনাপতিকে কৃষিদেবতা রূপে পুজো করা হয়। পুজোর আগে হয় হালা (গ্রামীণ হাল চাষ, মৃত্তিকা কর্ষণের যা প্রধান উপকরণ) পুজো। কল্পনা করা হয় যে ঠাকুরের বেদির সামনে এক ফালি জমি আছে যেখানে বাড়ির বাচ্চাকে জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার অভিনয় করতে হয়। বাড়ির মেয়ে বৌ র গান ধরেন~

“কার্তিকমাসে কাইতিনি

জমি চষি জাইগিনি

কার্ত্তিক তুমি শুনো না

ধান কেনো বোনো না… “

পুজো শেষে হয় ধান কাটা, মাপার অভিনয় দিয়ে। ধান মাপা হয় পুরা (অঞ্চলভেদে ধামা, চুবরী) হিসাবে। এক পুরা দুই পুরা দশ পুরা… ক্রমান্বয়ে। বাড়ির সকল সদস্যের নামে ধান মাপা হয়, বলা হয় ছড়া, গাওয়া হয় গীত-

“কাঠা আনো কাঠা আনো

ওগো কমলার মা

ওই কাঠা কমলার

তাইতে মাপো ধান গো মা

তাইতে মাপো ধান… “



অনুষ্ঠানের শেষ হয় নতুন চালের অন্ন দিয়ে। ব্রতের শুরুতে রান্নার উনুনে ও হাঁড়িতে সিঁদুর হলুদ ছুঁইয়ে নতুন চাল, সবজি, ছোলা-মটর ডাল, আলু, ঘি-তেল-নুন ইত্যাদি সব দিয়ে ব্রতের শেষে অগ্রহায়ণ এর প্রথম দিন এই রান্না হয়।



এই রান্নাপুজো শেষ হলে পরের দিন সকালে পুজোর স্থানে ধান, আদা হলুদ কচু গাছ রেখে, উঠোন লিপে, গঙ্গা জল ছড়িয়ে উনুন জ্বালিয়ে মাটি বা পেতলের হাড়িতে বসানো হয় নবান্নের আতপ চাল, মুগ-মটর ডাল, বাজারে নতুন আসা আলু, সীম, ছোট বেগুন, মুলো,খোসা সমেত মটরশুঁটি, বরবটি, কাঁচা লংকা, জলপাই ইত্যাদি।সব সেদ্ধ হয়ে এলে সৈন্ধব নুন, কাঁচা দুধ, ডাবের জল, মিছরি আর নারকেল কোরা দিয়ে ঘি ছড়িয়ে নামানো হয়। তারপর মাটিতে (ভূঁইয়ে) বসে বাড়ির ও আশেপাশের মানুষজন কলাপাতা বা সরায় করে এই অমৃতসম প্রসাদ গ্রহণ করেন। কার্তিক ষষ্ঠী যারা পালন করেন তাদের সেই ব্রত সম্পন্ন হয় এই অন্ন গ্রহণ করে ই।

এ যেন সত্যই এক সমৃদ্ধ গ্রামীণ জীবনচর্চা ও পরম্পরা, এক আদি অকৃত্রিম সমাজবান্ধব, প্রকৃতিবান্ধব সদাচার পালনপর্ব, আজকের যুগে ও যা সত্যিই অতুলনীয়… অনবদ্য! “



এই কার্তিক মাসে (নিয়ম মাস, নিয়মসেবা মাস) প্রতিদিন ঊষালগ্নে গ্রামের সকলে এবং আখড়ার বোষ্টমী দিদিরা, দাদারা, ভক্তরা নাম-সংকীর্তন সহযোগে প্রভাত ফেরী পরিক্রমায় বেরোন। তারা ঘুরে ফিরে গ্রামের সকল ঘরে ঘরে যান। ঘরে ঘরে গৃহস্থ্যরা ঊষা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন।হয়।

আজও মনে করা হয় এই নগরকীর্তন পরিক্রমার মাধ্যমে সকলের গৃহে মহাপ্রভুর আগমন ঘটে, তার পদধূলিতে রঞ্জিত হয়ে ওঠে সকল ধূলিকণা, মানবহৃদয়ে সঞ্চিত হয় ভক্তিরসধারা। এই চিরায়ত ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের মেলবন্ধনের সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে ই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে আমাদের ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির লোকধারা ও পরম্পরা।

উত্তর ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গ্রামে ও নগরে, এমনকি রাজধানী দিল্লির বিভিন্ন গুরুদ্বারা সন্নিহিত স্থানে কার্তিক মাসে এখনও হয় এই নগর কীর্তন, যা শুরু হয় গুরু পরবের আগে, শেষ হয় লোহরী (বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৌষ সংক্রান্তি) তে।

অঞ্চল বদলায়, ভাষা রীতিপ্রথা বদলায়, সীমানা বদল হয়, লোকাচার ভিন্নতা পায়। বদলায় না শুধু বিনি সুতোয় গাঁথা সেই মালা… আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোকাচার ।



আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.