প্রত্ন সম্পদে সমৃদ্ধ ত্রিপুরা, সুরক্ষা চাই

পান্নালাল রায়

November 17, 2025

ত্রিপুরার প্রত্ন ও প্রাচীন স্হাপত্য সম্পদ ক্রমেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।এই ধ্বংস প্রক্রিয়া অবশ্য শতাব্দীরও অধিক কাল আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বেশ কিছু রাজকীয় স্হাপত্য প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।ত্রিপুরার গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ সুরক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকায় খনন কার্য সহ আরও প্রত্ন অনুসন্ধানের দাবি উঠছে।

উত্তর পূর্বাঞ্চলের মধ্যে ত্রিপুরা একটি প্রত্ন সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল। এই রাজ্যের সবুজ প্রকৃতির পাশাপাশি নানা রাজকীয় স্হাপত্য আর বিরল প্রত্ন সম্পদ বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে।ত্রিপুরার উত্তরাঞ্চলে রয়েছে ভাস্কর্যের পাহাড় ঊনকোটি,দক্ষিণে পিলাকের বিগ্ৰহ বলয়। এ ছাড়াও আগরতলায় ত্রিপুরার গর্বের উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ,অমরপুরের দেবতামুড়ার ভাস্কর্য,উদয়পুরের প্রাচীন রাজপ্রাসাদ পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে।সর্বোপরি একান্ন পীঠের এক পীঠ মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির সারা বছর দেশের নানা অঞ্চলের পুণ্যার্থী মানুষকে কাছে টেনে নেয়।রাজ্যের পর্যটন সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সাম্প্রতিক কালে নানা কর্মসূচিও রূপায়িত হচ্ছে।এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রত্ন ও রাজকীয় স্হাপত্য সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ সহ আরও প্রত্ন অনুসন্ধানের দাবি উঠছে।

রাজ আমলেই ত্রিপুরার প্রাচীন রাজকীয় কীর্তি সমূহের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সুদীর্ঘকাল উদয়পুর ছিল ত্রিপুরার রাজধানী।স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল নানা রাজকীয় স্হাপত্য।১৭৬০ সালে মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন বর্তমান পুরান আগরতলায়।উদয়পুরে মাণিক্য যুগের বিভিন্ন স্হাপত্য ইতিমধ্যেই কালের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে।রাজ আমলে শুরু হওয়া ধ্বংস প্রক্রিয়া পরবর্তীকালেও অব্যাহত রয়েছে।মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য প্রায় শতবর্ষ আগেই উদয়পুরে গোবিন্দ মাণিক্যের রাজপ্রাসাদটি সংরক্ষণে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। রাজা 'আমার সোনামুড়া ও উদয়পুর বিভাগ পরিভ্রমণ' নামে প্রকাশিত তাঁর ডায়েরি গ্রন্হে লিখেছেন-"...উদয়পুরের পুরাণ দালানের মধ্যে এই রাজবাড়িটি সকলের চেয়ে বড়।ইহার বর্তমান অবস্থা একেবারে খারাপ হয় নাই।এই রাজবাড়িটিকে রক্ষা করা উচিত মনে করি।..." কিন্তু পরবর্তীকালে এই রাজবাড়িটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এমন কোনও তথ্য জানা নেই। আর সেদিন রাজা যে অবস্থায় প্রাসাদটি দেখেছিলেন পরবর্তী সময়ে তা যে আরও ধ্বংস হয়ে গেছে সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না।

উদয়পুরের জগন্নাথ মন্দিরটি হচ্ছে ত্রিপুরার একমাত্র মন্দির যা শ্লেট পাথরে নির্মিত। বর্তমানে ইতিহাস বিজড়িত এই মন্দিরটি প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে।কিন্তু শতাব্দীকাল আগেই এই ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক কে এন দীক্ষিত এই মন্দিরের দুর্দশা দেখে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং এর উপযুক্ত সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিলেন।সে কালের বিশিষ্ট স্হাপত্যবিদ শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই মন্দিরটি সম্পর্কে 'রবি' পত্রিকায় লিখেছিলেন যে,এর গঠন অবিকল সারনাথ স্তুপের মতো,অধিকন্তু তা পাষাণে নির্মিত। প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত 'উদয়পুর বিবরণ' গ্রন্হে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এই মন্দির সম্পর্কে বলেছেন,' এইরূপ বৃহৎ ও সুন্দর মন্দির এ রাজ্যে আর নাই, পূর্ববঙ্গেও আছে বলে জানা যায় না।' কিন্তু ক্রমে ক্রমে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে এই অনবদ্য স্হাপত্য নিদর্শন।

উদয়পুর,আগরতলা ছাড়াও রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও সাময়িক কালের জন্য ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। কিন্তু সে সব অঞ্চলে সব রাজকীয় কীর্তিচিহ্ণ এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।মহারাজা অমর মাণিক্য (১৫৭৭-৮৫ খ্রিঃ) তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অমরপুর। ধারণা করতে অসুবিধা হয় না যে রাজার নামেই রাজধানীর এই নামকরণ। কয়েক শতাব্দী আগে সেখানেও সেদিন নির্মিত হয়েছিল প্রাসাদ,মন্দির ইত্যাদি।খনন করা হয়েছিল সুবৃহৎ জলাশয়- যা কিনা আজও অতীত ঐতিহ্যের স্বাক্ষ্য বহন করছে। অমরপুরের নানা রাজকীয় কীর্তিচিহ্ণ আজ প্রায় বিলুপ্ত। শতাব্দীকাল আগেও অমর মাণিক্যের রাজ প্রাসাদের গাছগাছালি ঘেরা ভগ্ন দশা দৃষ্টিগোচর হতো,যা পরবর্তী সময়ে এক ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়।এই রাজকীয় কীর্তিচিহ্ণ যথা সময়ে যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে নিশ্চিত আরও কিছুকাল তা রাজকীয় কীর্তিচিহ্ণের উজ্জ্বল স্বাক্ষ্য বহন করতো।তবে শুধু অমর মাণিক্যের প্রাসাদই নয়,অমরপুরের অন্যান্য রাজকীয় কীর্তিচিহ্ণও আজ বিলুপ্ত। অমরপুরের স্হাপত্য নিদর্শনের পাশাপাশি দেবতামুড়ার বেশ কিছু প্রত্ন সম্পদও ইতিমধ্যেই বিনষ্ট হয়ে গেছে।অমরপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গোমতী নদীর গা ঘেঁষে পাহাড়ের গায়ে খোদিত রয়েছে নানা দেবদেবীর মূর্তি।দেবতামুড়ার ভাস্কর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মহিষাসুর মর্দিনী,পঞ্চ দেবতার প্যানেল ইত্যাদি।মহিষাসুর মর্দিনীর মূর্তিটি ১৩ মিঃ উঁচু ও ৭ মিঃ চওড়া।সিংহবাহিনী দেবীর হাতে রয়েছে নানা আয়ুধ।মহিষাসুরকে ত্রিশূল বিদ্ধ করছেন দেবী।দেবতামুড়ার ভাস্কর্য ত্রিপুরার খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন সম্পদ। কিন্তু কারা কবে নদীর কূল ঘেঁষা ঢালু পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদাই করে এমন আশ্চর্য সব ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিল তা আজও রহস্য ঘেরা।'রাজমালা'য় এমন কথা রয়েছে যে, ত্রিপুরা আক্রমণকারী পাঠান সেনাপতি হৈতেন খাঁর সঙ্গীরা এই সব মূর্তি খোদাই করেছিল। আবার কেউ বলেছেন দেবতামুড়া ত্রিপুরার রাজাদের প্রাচীন কীর্তিচিহ্ণ।প্রত্নতাত্ত্বিকদের কেউ কেউ আবার দেবতামুড়ার ভাস্কর্য দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের সৃষ্টি বলে ধারণা করেছেন।

এবার আসা যাক ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন ক্ষেত্র ঊনকোটির কথায়।পাহাড়ের গায়ে খোদিত বিশাল ভাস্কর্য, পৃথক বিগ্রহ, অরণ্য, ঝর্ণা সব মিলিয়ে এর যেন এক দুর্নিবার আকর্ষণ। কে বা কারা শত শত বছর আগে দুর্গম এই পাহাড়ে কেন যে এ রকম আশ্চর্য সব ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিল তা ভাবলে আজও আমাদের বিস্মিত হতে হয়।পুরাতত্ত্ব বিভাগের মতে ঊনকোটির শিব মূর্তি সমূহ খ্রিস্টীয় অষ্টম বা নবম শতাব্দীর। কেউ বলেছেন এটি পাল পর্বের শৈবতীর্থ। তবে ঊনকোটির ভাস্কর্য সমূহ এক সময়ে নির্মিত হয়নি।নানা সময়ে নানা ধ্যান ধারণায় ঊনকোটির ভাস্কর্য সমূহের সৃষ্টিকর্ম প্রভাবিত হয়েছে।যাইহোক, সুদীর্ঘকাল আগে থেকেই ভূমিকম্প সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রত্নভূমি ঊনকোটি বিনষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। ১৯০৩ সালে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য কৈলাসহর ও সন্নিহিত ঊনকোটি পরিদর্শন করেছিলেন। রাজার সভাপণ্ডিত চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ 'শ্রীশ্রী যুতের কৈলাসহর ভ্রমণ' পুস্তিকায় লিখেছিলেন-" ...পর্ব্বত পার্শ্বে বহুসংখ্যক মূর্তি খোদিত ছিল,কালক্রমে সমস্তই বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে।এখন যাহা আছে,তাহাও আর বেশীদিন থাকিবে বলিয়া বোধ হয় না।কারণ প্রস্তর ক্রমে ধ্বসিয়া পড়িতেছে।" মাণিক্য যুগের পরও ধ্বংসের এই ধারা অব্যাহত। ঊনকোটির বিগ্রহ সমূহের যথোপযুক্ত সংরক্ষণে সর্বস্তরে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগের বিষয়টি প্রশ্ন কন্টকিত! ঊনকোটি এলাকায় আরও প্রত্ন অনুসন্ধানের দাবিও উঠছে। কিছুদিন আগে ঊনকোটি সন্নিহিত দেওড়াছড়া এলাকা থেকে একটি বিগ্রহ উদ্ধার হয়েছে।এ এস আই কৈলাসহর অফিস থেকে বলা হয়েছে এটি অগ্নিদেব বিগ্রহ। এই পীঠভূমির আশপাশে এ রকম আরও বিগ্রহ আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঊনকোটি ও দেবতামুড়ার মতো অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নভূমি পিলাকও যথোপযুক্ত সংরক্ষণ তথা আরও উন্নয়নের দাবি রাখে।দক্ষিণ ত্রিপুরার পিলাককেও যেন ঘিরে আছে এক রহস্য। একদা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলন ঘটেছিল এখানে।কেউ কেউ বলেছেন, পিলাক এক সময় বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব পুষ্ট ছিল।আবার তার শিল্প সামগ্রী ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে।পিলাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা বিগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জলাশয়ের জন্য বা অন্য কোনও কারণে মাটি খনন করতে গিয়ে সে সব পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে ইটের পাঁচিলের ধ্বংস স্তুপ। এ সব কারণে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা জন্মে কোনও এক সময়ে এই অঞ্চলে হয়তো এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল।পিলাকের বিগ্ৰহ সমূহের সৃষ্টিকাল সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।উদ্ধারকৃত শিল্পকীর্তিও ত্রিপুরার প্রাচীনতম প্রত্ন নিদর্শন। পিলাক সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাটির নিচে আরও প্রত্ন সামগ্রী লুকিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।আরও উৎখনন ও যথাযথ সংরক্ষণের পাশাপাশি আরও ব্যাপক উন্নয়নের দাবি রাখে পিলাক। সব মিলিয়ে রাজ্যে পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি প্রত্ন ও স্হাপত্য সম্পদের যথাযথ সুরক্ষা সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রত্ন অনুসন্ধানেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আজ সময়ের দাবি!

আরও পড়ুন...


Post Your Comments Below

নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।

Free Download Avro Keyboard

Fields with * are mandatory





Posted comments

Till now no approved comments is available.