ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং মাদকের হুমকি: ত্রিপুরায় একটি নতুন অভিশাপ!
জয়ন্ত দেবনাথ
January 16, 2025
ত্রিপুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর ঘটনা প্রবাহ এবং যুব সমাজে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি এখন বড় দুটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় ত্রিপুরাতে প্রতি বছরই প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ, যার বেশিরভাগই ১৮-৪৫ বছর বয়সী। ২০২১ সালে ভারতে ১,৫৩,৯৭২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, এবং গত ৬ বছরে ত্রিপুরায় ৩৩০৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩৭২৪ জন। অর্থাৎ ত্রিপুরায় প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২২৩ জনের মৃত্যু হচ্ছে। এই চিত্রটি ত্রিপুরার মতো একটি ছোট রাজ্যের জন্য ভয়াবহ।
একই রকম ভাবে মাদকাসক্তিও ত্রিপুরায় সমান হারে তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করছে।গত তিন বছরে ১৬৬৫ টি মাদক সংক্রান্ত মামলা ত্রিপুরার বিভিন্ন থানায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ২৬৯৭ জন।ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ড. মানিক সাহা এবং পরিবহনমন্ত্রী শ্রী সুশান্ত চৌধুরী এই সমস্যা মোকাবিলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সড়ক নিরাপত্তা এবং মাদকবিরোধী কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কলেজ স্তরে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। ইতিমধ্যেই উদয়পুরে গত ১১ জানুয়ারি দক্ষিণ জেলা, গোমতী জেলা ও সিপাইজলা জেলার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে একটি কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১৮ জানুয়ারি একই উদ্দেশ্যে কুমারঘাটে উত্তর জেলা, ঊনকোটি জেলা ও ধলাই জেলার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে একটি কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। তার পর ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর আগরতলায় অনুষ্ঠিত হবে খোয়াই ও পশ্চিম জেলার ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে জেলা ভিত্তিক তৃতীয় পর্যায়ের ক্যুইজ অনুষ্ঠান। চুড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী আগরতলার রবীন্দ্র ভবনে।

ত্রিপুরাতে গত দুই দশকে ভয়াবহ বৈরী সন্ত্রাসী কার্যকলাপেও এত লোক মারা যায়নি গত এক দশকে যান দুর্ঘটনা ও নেশার কবলে পড়ে এত লোক মারা গেছে। তাই ত্রিপুরার যুব সমাজের ভবিষ্যৎ রক্ষার স্বার্থে, সড়ক নিরাপত্তা ও মাদকবিরোধী আন্দোলনকে একটি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে নিতে সবার প্রতি বার বার আহ্বান জানাচ্ছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডঃ মানিক সাহা ও যুব আইকন বলে পরিচিত ত্রিপুরার পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী।ত্রিপুরা সরকারের পরিবহণ দপ্তরের একটি তথ্য থেকে জানা গেছে ২০২১ সালে ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১,৫৩,৯৭২ জনের। এর মধ্যে ১৮-৪৫ বছর বয়সীদের সংখ্যা ছিল ৬৭%। ত্রিপুরায় ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৪১ জন এবং ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬১-এ।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত মাদক সেবন করে যানবাহন চালানোর কারণে। মাত্রাতিরিক্ত মাদকাসক্তির কারণে ত্রিপুরাজুড়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা শুধু সামাজিক ক্ষতিই করছে না, বরং সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানকেও প্রভাবিত করছে।
ত্রিপুরা সরকার সড়ক দুর্ঘটনা এবং মাদকাসক্তি প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী ডঃ মানিক সাহা নিজে একাধিকবার নেশা বিরোধী অভিযানে পুলিশকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান ও জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। কিন্তু তার পরেও নেশা জাতীয় দ্রব্যের আমদানি ও ব্যবহারে লাগাম টানা যাচ্ছে না। একই রকম ভাবে লাগাম টানা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর।
দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ত্রিপুরায় জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা কমিটি গঠিত হয়েছে। পরিবহন দপ্তর এবং ট্রাফিক পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে ট্রাফিক নিয়ম কার্যকর করতে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ আইন প্রয়োগের নামে যানবাহন চালকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের জন্য যতোটা সচেষ্ট তার শিকি ভাগ প্রচেষ্টাও দেখা যায় না দ্রুত গতিতে ও বেপরোয়া হয়ে যান বাহন ও মোটর বাইক চালকদের পাকড়াও করতে।কেননা, যেই গতিতে মাদক ব্যবসা ও সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেই অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ক্ষেত্র পর্যায়ে কার্যকর করা যাচ্ছে না। তাই ইদানিং দাবি উঠেছে সড়ক নিরাপত্তা ও মাদকবিরোধী সচেতনতা কর্মসূচিকে স্কুলের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার ।ত্রিপুরাতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনার শিকার তরুণ যান ও মোটর বাইক চালকেরা প্রভাবিত ছিলেন মাদকে। তাই ত্রিপুরার সামাজিক সমস্যা হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা এবং মাদকাসক্তি রোধে নিম্নলিখিত উদ্যোগ গুলো কার্যকর হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা-
১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তা ক্লাব গঠন এবং সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা।
২. অভিভাবক-শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈঠকে সড়ক নিরাপত্তা এবং মাদকবিরোধী বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩.শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানের দক্ষতা বৃদ্ধি।
৪.মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকরী কেন্দ্র স্থাপন।
৫. প্রচার মাধ্যম, বিশেষতঃ জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য মিডিয়া গুলোর মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা ও মাদক বিরোধী লাগাতার প্রচার চালাতে হবে।
এককথায় সড়ক দুর্ঘটনা এবং মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ ও জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি নীতিমালা এবং সামাজিক প্রচেষ্টা একত্রে কাজ করলে ত্রিপুরার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।ভারতের মাদক পাচার ও মাদকাসক্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টোও সম্প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত এক মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেছে যে মাদকাসক্তি কোনোভাবেই গর্ব করার মতো আকর্ষণীয় কোন বিষয় নয়। এর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক প্রভাব ভয়াবহ।বিচারপতি বি.ভি. নাগরত্ন ও এন. কোটীশ্বর সিং-এর বেঞ্চ পাকিস্তান থেকে ভারতের সীমানায় নৌপথে হেরোইন পাচারের একটি মামলায় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA)-এর তদন্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, মাদকাসক্তি জাতির যুবসমাজের অগ্রগতির সম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও এটি এক গুরুতর হুমকি।মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অভিভাবক, সমাজ এবং সরকারের সমন্বিত ভূমিকার উপর জোর দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।আদালত অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাদক চক্রের বিপদ মোকাবেলায় সবাইকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে অনুরোধ করেছে।একই সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালত মাদকাসক্তদের প্রতি সহানুভূতির সাথে আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। তাদের পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি জাতীয় আইন পরিষেবা কর্তৃপক্ষ (NALSA)-কে এই সমস্যা মোকাবিলায় একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ত্রিপুরাতে এই সংস্হার মাদক বিরোধী প্রচারণা বা অভিযানে কোনো রকম ভূমিকা নেই। আর এরাজ্যের পুলিশ মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান বা ধরপাকড় চালালেও নেশা কারবারীদের আসল চাইদের ধাঁরে কাছেও পৌঁছুতে সক্ষম হয় না।অতি সম্প্রতি এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ই ডি) এর অফিসাররা ত্রিপুরায় এক ডজনেরও বেশী জায়গায় মাদক বিরুধী অভিযান চালালেও পাচার চক্রীদের মূল হুতাদের একজনকেও পাকডাও করতে সক্ষম হয়নি। একই রকম ভাবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও একের পর এক নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও কাঙ্খিত ফল আসছেনা।ভারত সরকারের সড়ক পরিবহন ও জাতীয় মহাসড়ক মন্ত্রক ২০২১ সালের ৪ঠা অক্টোবর "সুনাগরিক" প্রকল্প চালু করেছে, যার মাধ্যমে পথ দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের সাহায্যকারী ব্যক্তি বা সংস্থাকে পুরস্কৃত করা হয়। যদি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গে বা এক ঘণ্টার মধ্যে (গোল্ডেন আওয়ার) চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন, তবে তাদের ৫,০০০ নগদ পুরস্কার এবং একটি শংসাপত্র প্রদান করা হয়। একজন সুনাগরিক এক বছরে সর্বোচ্চ পাঁচবার এই সুবিধা পেতে পারেন।এছাড়াও, বছরের শেষে পুরস্কৃত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে ১০ জনকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। এই জাতীয় পুরস্কারের মূল্য ১,০০,০০০। "গুড সামারিটান" আইন অনুযায়ী, সুনাগরিকদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়, যাতে তাদের পুলিশ বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের হয়রানির শিকার হতে না হয়।উক্ত প্রকল্পের আওতায় সুবিধা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসকের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন সহ আবেদন করতে হবে। ভারত সরকার হিট-এন্ড-রান মোটর দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে: ২,০০,০০০ এবং গুরুতর আহতের ক্ষেত্রে: ৫০,০০০ টাকা প্রদানের সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু সমসসা হলো সরকারী ও প্রশাসনিক এইসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ ততটা নেই যতটা নেওয়া উচিত ছিল। একই অবস্থায় এইচ আই ভি এইডস এর সংক্রমণ জনিত ঘটনাও। ত্রিপুরাতে এইচ আই ভি এইডস এর রোগীর সংখ্যাও দ্রুত বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চললেও রাজ্য এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি ঠুঁটোজগন্নাথ। সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ বছরে (২০১৫-২০২৩) ত্রিপুরা রাজ্যে এইডসে ৫১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট ২৪৭৪ জন এইডস রোগী চিহ্নিত হয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী ডঃ মানিক সাহা-এর বিধানসভায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর নতুন রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজ্য সরকার এইডস প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিলেও সমাজে সচেতনতার অভাব এবং সময়মতো চিকিৎসা না হওয়া এইডস আক্রান্তদের মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধির মূল কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
( লেখক একজন সিনিওর সাংবাদিক ও ত্রিপুরাইনফো ডটকম এর সম্পাদক)
আরও পড়ুন...