বেনে বৌ
অরিন্দম নাথ
আমরা আগরতলার নন্দন নগরে যে পাশটায় থাকি সেখানে প্রচুর গাছপালা ৷ আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, লিচু, জারুল, সেগুন, বাঁশ, শিমুল, গামার, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর ইত্যাদি পরিচিত গাছ ৷ এছাড়াও ছোট ঝোপ-ঝাড় নজরে আসে ৷ আনারসের বাগানের জন্য আমাদের এলাকা প্রসিদ্ধ ৷ একদিন একটি শেওড়া গাছ দেখেছি ৷ আরেকদিন মন গাছ দেখে প্রভূত আনন্দ পেয়েছি ৷ প্রকৃতির এই উদারতার কারণে সারা বছর প্রচুর পাখি আসে ৷ কাক, শালিক, চড়ুই, বুলবুল, দোয়েল, টিয়া, ময়না, কোকিল, টুনটুনি, বাবুই, ফিঙ্গে, ঘুঘু, পায়রা, কাঠঠোকরা, মাছরাঙ্গা, বক, চিল ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি প্রজাতির পাখির দেখা মিলে ৷ ইদানীং একটি হলদে পাখি প্রতিদিন একবার করে হাজিরা দেয় ৷ পাখিটির সাথীটিকে দেখতে পাই না ৷ যেদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি সেদিন পাখিটিকে আমাদের বাগানের উপর দিয়ে টানা তারের উপর বসে থাকতে দেখি ৷ তারপর পাখিটি তার প্রাতকালীন সফরে বেড়িয়ে পড়ে ৷ তখন তাকে আশ-পাশের ঝোপ-ঝাড়ে নজরে আসে ৷ প্রায় তিন থেকে চার বর্গ-কিলোমিটারের মধ্যে সে ঘুরা-ফেরা করে ৷ কিন্তু তখনও সে একাই থাকে ৷
হলদে পাখি আমার প্রিয় ৷ বছর কয়েক আগে ত্রিপুরা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে ভাষণ দেবার সুযোগ হয়েছিল ৷ কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপর অত্যাচার ৷ এই ছিল বিষয় ৷ অন্য যারা আমন্ত্রিত ছিলেন সবাই মহিলা ৷ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ৷ বক্তব্যের সুবিধার জন্য আমি একটি পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানিয়েছিলাম ৷ শেষে জুড়ে দিয়েছিলাম হলুদ পাখির একটি ছবি ৷ এর একটি কারণ ছিল ৷ হলদে পাখির বাংলা নাম বেনে বৌ ৷ ইংরেজি নাম ব্ল্যাক হেডেড ওরিয়ল ৷ পাখিটি একটি দুঃখিনী নারী চরিত্র ৷ আমি সেই গল্প বলে বাহবা কুড়িয়েছিলাম ৷
পাখিটিকে নিয়ে বাংলায় অনেক উপকথা চালু আছে ৷ প্রখ্যাত পক্ষীবিদ অজয় হোম পাখিটিকে বেনে বৌ নামে উল্লেখ করেছেন ৷ এক বেনে বাড়িতে সাত ছেলের সাত বৌ ৷ সকাল বেলায় সাত ছেলে কাজে বেরিয়ে যায় ৷ ফেরে সেই সন্ধে বেলায় ৷ সাত বৌকে সাত রকম ব্যঞ্জন রাঁধতে হয় ৷ বৌদের মধ্যে যার রান্না যেদিন খারাপ হয় সে মার খায় সাত ভাইয়ের হাতে ৷ এমনি ভাব ছিল ভাইদের মধ্যে ৷ সেদিন ডাল রাঁধার ভার ছিল বেনেদের ছোট বৌয়ের ৷ তখনকার দিনে রান্না হত মাটির হাঁড়িতে ৷ সেদিন ছোট বৌ ডালে যতই হলুদ ঢালে কিছুতেই ডাল আর হলুদ হয় না ৷ বড় জায়েদের বলে, ‘দেখ না দিদি কিছুতেই রঙ হচ্ছে না, কি যে করি ?’
তারাও দেখল সত্যি ডালে রঙ হচ্ছে না ৷ ডালে রঙ না হলে ভাইয়েরা ওর উপর হামলে পড়বে ৷ এই ভেবে, শেষে মনের দুঃখে ওই ডালের হাঁড়ি দু`হাতে উপরে তুলে নিজের মাথায় ভেঙে ফেলল ৷ ভাঙতেই ছোট বৌ একটি পাখি হয়ে উড়ে গেল ৷ সেই পাখিই বেনে বৌ ৷ যেসব জায়গায় পোড়া হাঁড়ির কালো দাগ লেগেছিল সে সব জায়গা কাল ৷ আর যেসব স্থানে ডাল গড়িয়ে পড়েছিল সেসব স্থানে ডালের পাকা হলুদ রঙ ৷
আরেকটি গল্পে পাখিটিকে কল্পনা করা হয়েছে চাষার মেয়ে রূপে ৷ তার রূপ ছিল পাশ্চাত্যের সিন্ডারেলার মত ৷ গরীব কৃষকের ঘরের মেয়ের অসামান্য রূপের কথা সেই দেশের রাজপুত্তুরের কানেও পৌঁছালো ৷ মেয়েটি সত্যি সুন্দরী কি না, তা দেখতে রাজামশাই মন্ত্রীকে পাঠালেন ৷ মন্ত্রীমশাই হাতির পিঠে চড়ে একদিন এলেন চাষার গ্রামে ৷
গাঁয়ের লোকেরা আগে হাতি দেখেনি কখনও ৷ সবাই বেরিয়ে এল, যে যার ঘর থেকে হাতি দেখতে ৷ কৃষকের মেয়েটিও বেরিয়ে এল ৷ মন্ত্রী মশাই দেখলেন ৷ দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন মেয়েটি সত্যি সুন্দরী ৷ এই মেয়ের সৌন্দর্যের কাছে মণি-মাণিক্যের বাহার কিছুই নয় ৷ মেয়েটির চোখ যেন নীল পদ্ম ৷ মুখ যেন আকাশের চাঁদ ৷ নাক যেন তিলফুল ৷ ঠোঁট যেন রাঙা প্রবাল ৷ মন্ত্রীমশাই তখনই রাজপুত্তুরের জন্য সেই মেয়েকে পছন্দ করলেন ৷
কিন্তু মন্ত্রী মশাইয়ের মন খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে গরিবের মেয়ে, রাজপুত্তুরের সাথে বিয়ে হলে আর এই কুঁড়ে ঘরে আসতে পারবে না ৷ মন্ত্রী মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের কথা পাড়লেন ৷ চাষা বলল, আমার মেয়ে সুখে থাকলেই হল ৷ মেয়ে আমার বাড়িতে না আসলেও চলবে ৷ মহা ধুম-ধামে চাষার সাথে রাজপুত্তুরের বিয়ে হয়ে গেল ৷ রাজপুত্তুরের মনটি ছিল সত্যি খুব ভাল ৷ শত হলেও চাষা তার শ্বশুরতো বটে ৷ সে শ্বশুর মশাইকে বলল, সুযোগ পেলেই বৌ-কে নিয়ে আসবে ৷ কিন্তু শুধু পূর্ণিমার রাতেই ৷ অন্য কখনও নয় ৷ এরপর অনেক পূর্ণিমার রাত গেল ৷ মেয়ে কিংবা মেয়ে-জামাই কেউ আসে না ৷
এক পূর্ণিমার রাতে চাষা ভাবতে থাকল, আমি যদি পাখি হতে পারতাম ৷ তাহলে খুব সহজেই উড়ে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে পারতাম ৷ যেমনই এ ভাবা, অমনিই সে একটা পাখি হয়ে গেল ৷ আমাদের হলুদ পাখি ৷
রোজ রোজ একাকী পাখিটিকে দেখতে খারাপ লাগে ৷ আমি তার নিঃসঙ্গতার কারণ খুঁজার চেষ্টা করি ৷ ব্ল্যাক হেডেড ওরিয়ল ট্রপিক্যাল আবহাওয়া পছন্দ করে ৷ আমাদের ত্রিপুরার উপর দিয়ে চলে গেছে কাল্পনিক কর্কট-ক্রান্তি রেখা ৷ সুতরাং ত্রিপুরার আবহাওয়া বেনে বৌয়ের পছন্দের ৷ পোকা-মাকড় এবং ফল, বিশেষ করে ডুমুর ফল বেনে বৌয়ের পছন্দের ৷ বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা পাখিদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষা চলায় ৷ সংস্থার শেষ রিপোর্ট বছর তিনেক আগে প্রকাশ পেয়েছে ৷ রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত দশকে বেনে বৌদের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ পাখিটিকে কোনও ভাবেই বিরল প্রজাতির বলা যায় না ৷ আমার বেনে বৌ কেন একা ? কেন আমরা এই হলদে পাখিটিকে শালিক, চড়ুই, ঘুঘু ইত্যাদি আপাত বিবর্ণ পাখিদের মত পর্যাপ্ত দেখি না ? পাখিদের সৌন্দর্য-জ্ঞান কি মানুষের চেয়ে ভিন্ন ? প্রকৃতিই কি ঠিক করে দেয় পাখিদের সংখ্যার অনুপাত ?
এই প্রশ্নগুলি গত কয়েকদিন যাবত আমকে খুব ভাবাচ্ছিল ৷ স্ত্রীকে বলায় সে মোবাইল দিয়ে বেনে বৌয়ের একটি ছবি তুলল ৷ ভাবছিলাম ছবিটি সহ বদন-কিতাবে একটি পোস্ট দেব ৷ সেদিন খুব ভোরে উঠে লিখছি ৷ বাইরে বেশ কুয়াশা পড়েছে ৷ সাথে কিছুটা ঠাণ্ডা ৷ গতবার সেমিনারে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম ৷ তখন শীতকাল ৷ সেই টাকা দিয়ে সেদিনই একটি সোয়েটার কিনেছিলাম ৷ হলদে রঙের ৷ ভাবলাম সেই সোয়েটারটি পড়ব ৷ ঠিক তখনই বাইরে পাখিটির গলা পেলাম ৷ অন্য পাশের জানালার দিকে ৷ জানলা খুলে তাকিয়ে দেখি বেনে বৌ একটি গামার গাছে বসে আছে ৷ তবে সে একা নয় ৷ তার সাথে তার জুড়িটিও আছে ৷ আমার মন খুশিতে ভরে উঠল ৷
আরেকটি সত্য অনুভব করলাম আমার বেনে বৌ স্ত্রী প্রজাতির ৷ পুরুষটি লাজুক প্রকৃতির ৷ তার নামের শেষের ‘বৌ’ উপাধি পুরুষটির পছন্দ নয় ৷ আমার হলুদ পাখিটি আঁচ করতে পেরেছিল তাকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে যাচ্ছি ৷ তাই অনর্থ হবে ভেবে তার লেইট-রাইজার মরদটিকে নিয়ে সেদিন বেরিয়েছিল ৷
[বিঃদ্রঃ – পাখিদের নিয়ে এমনি নানা কাহিনী জানতে পারবেন আমার লেখা ‘দুই ভুবন’ বইটি পড়লে ৷ পাবেন জ্ঞান-বিচিত্রা/ বুক-ওয়ার্ড স্টলে ৷]