রাজ্যে এক্ষণে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ২.৫ লাখ! মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ও বাস্তব
জয়ন্ত দেবনাথ
গোটা দেশই আজ একটা আর্থিক মন্দার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। আর এর থেকে বাদ যায়নি আমাদের ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরাও। সরকারী দপ্তরের চাকুরীর সুযোগ যেহেতু এরাজ্যে আনেকটাই সীমিত তাই রাজ্যের নয়া সরকার বেকারদের কর্ম সংস্থানের লক্ষ্যে স্বরোজগারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এলক্ষ্যে বেকারদের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ছোটখাটু ব্যবসা বানিজ্য ইত্যাদি করার পরামর্শ দিচ্ছেন আমাদের তরুন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি চাকরির সুজুগ কম এটা বুজতে পেরে অনেকেই এপথে এগুচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী এতে সাফল্যও এসেছে। কম করেও সাড়ে পাঁচ লাখ বেকার মুদ্রা যোজনা, স্কিল ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী স্বরোজগার যোজনা, স্বাবলম্বন, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া ইত্যাদি নানা সরকারী প্রকল্পের সুযোগ নিয়েছেন। এবং স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মখ্যমন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী, রাজ্যে এক্ষণে বেকারের সংখ্যা কমে আড়াই লাখ –এ এসে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, নেশন্যাল ক্যারিয়ার সার্ভিস পোর্টালের ডাটাবেস-এ আগে রাজ্যের বেকারদের পরিসংখ্যান সঠিক ছিল না। পূর্বতন সরকার নেশন্যাল ক্যারিয়ার সার্ভিস পোর্টালের ডাটাবেস সঠিক ভাবে আপডেট করেনি। ভুল তথ্যে ভরা ছিল। তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডাটাবেস আপডেট করা হয়। তাতে বহু মৃত লোক- এর নাম রয়ে গেছিল। এমন বহু লোকের নাম ছিল যারা চাকুরী পেয়ে গেছেন। এক্ষণে তাদের নাম বাদ পড়েছে। এই অবস্থায় ডাটাবেস-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এরাজ্যে এক্ষণে ২.৫ লাখের মতো বেকার রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর আরও দাবী, রাজ্যে সাড়ে সাত লাখ বেকারের গল্প প্রচার করে এতদিন বহিঃরাজ্যের মানুষের সামনে রাজ্যের বদনাম করা হচ্ছিল। তাই তিনি দ্রুত নেশন্যাল ক্যারিয়ার সার্ভিস ডাটাবেস পোর্টালে ত্রিপুরার বেকারদের পরিসংখ্যান আপডেট করে বহিঃ রাজ্যের মানুষের কাছে ত্রিপুরার বেকার চিত্র সুস্পস্ট ভাবে তুলে ধরেছেন। এর ফলে এক্ষণে তিনি দিল্লিতে গিয়ে সিনা ঠুকে বলতে পারছেন ত্রিপুরাতে বেকারের সংখ্যা কমেছে। সিপিএম এতদিন বেকারদের নিয়ে শুধু রাজনিতি করেছে। সরকারি চাকরিও দেওয়া হয়নি, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হ্য়নি। আমি মুখ্যমন্ত্রীর বেকার পরিসংখান বা সাড়ে পাঁচ লাখ বেকার মুদ্রা যোজনা, স্কিল ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী স্বরোজগার যোজনা, স্বাবলম্বন, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া ইত্যাদি নানা সরকারী প্রকল্পে ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যপারে দ্বিমত পোষণ করছিনা। কিন্তু বাস্তবে এখনু এরাজ্যের বেকার যুবক যুবতিরা কতটা সরকারি চাকরি-মুখি তা আমরা দু’একটি সরকারী চাকুরীর বিজ্ঞাপনের দিকে তাকালেই তার একটা অনুমান করতে পারবো।
সম্প্রতি রাজ্য গ্রামোন্নয়ন দপ্তর ষোলশ’র মতো গ্রাম রোজগার সেবক (জি আর এস) –এর অস্থায়ী পদে লোক নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারী করেছিল। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর এই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেখা গেছে প্রায় ৪০ হাজারের মতো বেকার এই পরীক্ষায় বসেছে। যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল মাধ্যমিক পাশ। খবর নিয়ে জেনেছি এম এ, এম কম এমনকি পি এইচ ডি করছেন এমন বেকারাও এই চাকুরী পরীক্ষায় বসেছিল।
দ্বিতীয় এধরনের আরও একটি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে রাজ্য পুলিশের টি এস আর বাহিনীতে নিয়োগ নিয়ে। এক্ষেত্রেও টি এস আর আই আর –এর দুটি বাহিনীতে ২৪০০ লোক নিয়োগ হবে। দেখা গেছে এক্ষেত্রে ন্যুনতম মাধ্যমিক পাশ যোগ্যতার এই চাকুরী পরীক্ষার জন্য অনলাইনে কম করেও দেড় লাখ ছেলেমেয়ে আবেদন করেছেন। উল্লিখিত দু’টি চাকুরী পরীক্ষার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী আবেদনকারীদের সংখ্যার বিচারে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় এখনো এরাজ্যের বেকাররা সরকারী চাকুরীর জন্য কতটা ব্যাকুল। কিন্তু তাই বলে এরাজ্যে স্বরোজগারী হতে কেউই চায়না এটাও ঠিক নয়। মুখ্যমন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী সাড়ে পাঁচ লাখ বেকার ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ইতিমধ্যেই স্বনির্ভর হয়ে গেছেন।
সম্প্রতি রাজ্যের সিনিয়র কিছু সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সাথে এক নৈশভোজে খোলামেলা আলোচনাকালে মুখ্যমন্ত্রী এসব তথ্য দিয়েছেন। এই প্রতিবেদকও মুখ্যমন্ত্রীর এই নৈশভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন। প্রায় দেড় দুই ঘন্টার খোলামেলা আলাপাচারিতায় মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরাকে মডেল রাজ্য বানাতে কিভাবে কি করতে চান তার বিস্তৃত তথ্য তোলে ধরেছেন। অবশ্য এদিন মুখ্যমন্ত্রী শুধু তার নিজের ভাবনার কথাই ব্যক্ত করেছেন। কোন সাংবাদিক কোন প্রশ্ন করেননি। মুখ্যমন্ত্রীও সাংবাদিক বা সম্পাদকদের কাছ থেকে কোন পরামর্শ বা তাদের মতামত চাননি। মুখ্যমন্ত্রী চাইলে হয়তো অনেকেই যে যার মতো কিছু সুপরামর্শ দিতে পারতেন বা দিতেন। সে যাই হোক মুখ্যমন্ত্রীর সেদিনের ভাবনা চিন্তা থেকে অন্যতম যে বিষয়টি উঠে এসেছে তার মর্মার্থ হলো – এরাজ্যে সরকারী দপ্তরে আর খুব বেশী চাকুরী দেওয়া যাবে না। কেননা, সারা দেশের যে কোন রাজ্যের তুলনায় এরাজ্যের প্রশাসনে অন্তত দ্বিগুনেরও বেশী ‘রেসিও’ – তে ৪.৫% হারে সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা। রাজ্য বাজেটের একটা সিংহভাগ অর্থ সরকারী কর্মচারীদের বেতন ক্ষাতেই চলে যায়। তার মধ্যে আবার সরকারী কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করতে গিয়ে প্রতি বছর নূন্যপক্ষে সাড়ে সাতশ কোটি টাকা অতিরিক্ত সরকারী কোষাগার থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই চতুর্দশ অর্থ কমিশন থেকে টাকা কম পাওয়া গেছে। সরকারের উপর ঋণের চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম করেও এমুহূর্তে ত্রিপুরা সরকারের ঋণের পরিমান প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এই অবস্থায় সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সবটা না হলেও যা কিছুই বেতন বাড়ানো হয়েছে তার চাপ স্বাভাবিক কারনেই এরাজ্যের উন্নয়ন মূলক কাজের উপর পড়েছে। আর তার ফলশ্রুতিতে বেকারদের চাকুরীর যাও কিছু সুযোগ ছিল তা আপাতত বন্ধ প্রায়। এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্ষ হল-স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পে ঋণ নিয়ে বেকাররা স্বনির্ভর হন। মুখ্যমন্ত্রীর স্বনির্ভর হওয়ার এই ধরনের পরামর্ষ বেকারদের আগেও দিয়েছেন। কিন্ত সমস্যা হল, এরাজ্যের বাজার খুবই সীমিত। বাইরের কোম্পানীর লগ্নী প্রায় নেই বললেই চলে। তাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহিঃরাজ্যের কিছু কোম্পানি এ রাজ্যে আসলেও তারাও মূলত এরাজ্যের ছোট মাঝারি কোম্পানী গুলি স্থানীয় ভাবে যা করতে পারতো তাতেই থাবা বসাচ্ছে। ছোটখাটু ঠিকাদারি কিংবা পরিষেবার কাজ গুলিও একাংশ বহিঃরাজ্যের কোম্পানী গুলি আজ ছিনিয়ে নিচ্ছেন। অথচ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় উদ্যোগীদের কথা মাথায় রেখে স্থানীয় শিল্প উদ্যোগী বা পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা গুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে ত্রিপুরা শিল্প বানিজ্য এবং তথ্য প্রযুক্তি নীতি-তে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বলা হয়েছিল স্থানীয় উদ্যোগীরা করতে পারবে এসব কাজে বাইরের কোম্পানীকে কোনভাবেই প্রাধান্য দেওয়া হবেনা। আর এলক্ষ্যে স্থানীয় কোম্পানীগুলির স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে ত্রিপুরা ইন্ডাস্ট্রি ও আইটি পলিসি-তে স্থানীয় সংস্থা গুলির জন্যে ২০% প্রাইস প্রেফারেন্সের কথা বলা হয়। আর এসব কিছু যাতে স্বচ্ছতার সাথে করা যায় এলক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের কাজটি ‘ই টেন্ডারিং’-এর মাধ্যমেই করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজ্য অর্থ দপ্তরের মাধ্যমে ‘ই টেন্ডারিং’-এর জন্য একটি নীতিমালাও ঘোষণা করা হয়। তাতেও স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল স্থানীয় সংস্থাগুলি করতে পারবে এমন কোন কাজই বাইরের সংস্থাগুলিকে দেওয়া যাবেনা। যেসব বড়সর কাজকর্ম স্থানীয় ভাবে করা সম্ভব নয়, শুধু সেসব ক্ষেত্রে বহিঃরাজ্যের কোম্পানিকে ডাকা যেতে পারে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ‘ই টেন্ডারিং’- চালুর পর স্থানীয় কোম্পানী গুলি দক্ষতা বা পারদর্শিতা থাকা সত্বেও কোন কাজই পাচ্ছেনা। টেন্ডার ডকুমেন্ট গুলিই এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, দক্ষ লোকবল স্থানীয় ভাবে থাকা সত্বেও এমন উচ্চহারে টেন্ডারে কোম্পানীর টার্ন ওভার চাওয়া হচ্ছে বহুক্ষেত্রে স্থানীয় কোম্পানীগুলি দরপত্রই জমা দিতে পারছে না। টেন্ডার আহ্বানে রাজ্য আইটি, ইন্ডাস্ট্রি পলিসিকে অমান্য করার এমন একাধিক ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। উচ্চতর রাজনৈতিক ও প্রশাসনের গোচরে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষেত্রে টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য ও বহিঃ রাজ্যের কিছু অফিসার আমলা বহিঃরাজ্যের কিছু কোম্পানীর সাথে গোপন বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ‘টেন্ডার’ – জালিয়াতির এই শিলসিলা চালিয়েই যাচ্ছেন।
নয়া সরকারের মন্ত্রীরা সবাই এখনো প্রশাসনিকভাবে ততটা পটু নয়। আর এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছেন একাংশ অসাধু অফিসার আমলা। আর বঞ্চিত স্থানীয় উদ্যোগীদের প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে, আমরা অসহায়। সবকিছু ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে উপর থেকে। ইঙ্গিত করা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর অফিস, অন্যমন্ত্রী কিংবা সচিব পর্যায়ে সব কিছু হচ্ছে। নীচু স্তরের অফিসারদের তরফে বলা হচ্ছে আই টি বা ইন্ডাস্ট্রি পলিসি কিংবা স্থানীয় সংস্থা গুলির জন্যে প্রাইস প্রেফারেন্স কিংবা এমএসইমি গাইডলাইন এসব কথা আমাদের শুনিয়ে লাভ নেই। উদ্ভত অবস্থার প্রেক্ষিতে স্থানীয় বেকারকুল নতুন করে ব্যবসামুখী হবেন দূরের কথা চালু উদ্যোগ গুলিই আজ বন্ধের মুখে। অথচ রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলেই সরকারী আধা সরকারী দপ্তর গুলির ছোট খাটু কাজ গুলি স্থানীয় উদ্যোগীদের দিয়ে করাতে পারতেন। কিন্তু এটা না করে উল্টো ছোট ছোট কাজ গুলিকে একত্র করে এমনভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে, এর ফলে স্থানীয়ভাবে দক্ষতা বা প্রযুক্তি থাকলেও গোপন বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ চলে যাচ্ছে বহিঃ রাজ্যের কোম্পানী গুলির হাতে। আর তাতে স্থানীয় ও বহিঃরাজ্যের কিছু অফিসার আমলার পকেটভারী হলেও স্থানীয় উদ্যোগী কিংবা বেকারদের কোন লাভ হচ্ছে না। কাজ হারাচ্ছেন স্থানীয়রা। মুখ্যমন্ত্রী বা তার অফিস এটা জানেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্ত এটাই বাস্তাব ঘটনা। আর এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে এরাজ্যের উদ্যোগীদের আরও বেশী করে আর্থিক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। উচ্চ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বকে গভীরভাবে এসব বিষয় গুলি নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। অন্যথায় নিকট ভবিষ্যতে রাজ্যের বেহাল আর্থিক অবস্থা আরও বেহাল হবে । রাজ্যে বেকারত্ব ও দারিদ্রতা বাড়বে। স্থানীয় মানুষ আরও বেশী করে কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়বে।