ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা স্বতন্ত্রতা ও ন্যায় বিচার : বিলম্ব ও বিড়ম্বনা

ড. বিভাস কান্তি কিলিকদার

(৩০-৪-২০২৪ সন্ধ্যায় ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদের দক্ষিণী গৃহে প্রদত্ত ভাষণ)

আইনের অনুশাসন এবং তাকে সুসংহত রাখা ভারতীয় সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ। আইনের অনুশাসন ভারতীয় জনগণের একটা নিছক চাহিদা বা আকাঙ্খাই নয়, তা যে কোনও ব্যক্তি, সরকার এমনকি বিচার বিভাগের কাছেও সমভাবে বলবৎযোগ্য। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং আমাদের সমগ্র আইন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে আইনের অনুশাসনের আদর্শ। ভারতীয় সংবিধান বিচার বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে সংবিধানের অভিভাবক রূপে আইনের অনুশাসনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে যে বিচার বিভাগ সংবিধানকে রক্ষা ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। বিচার বিভাগ সরকারের অন্য যে কোনও বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র। সংবিধানের পরিপন্থী হলে আইন সভায় প্রণীত যে কোনও আইনকে বাতিল করে দিতে পারে বিচার বিভাগ।



প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা – প্রাসঙ্গিক মূল্যায়ণ ও কিছু প্রস্তাব

আমরা যে বিচার ব্যবস্থা ও পদ্ধতি প্রকরণে অভ্যস্ত হয়েছি-কয়েক প্রজন্ম ধরে তার আতঙ্কজনক ত্রুটি প্রকট থেকেপ্রকটতর হচ্ছে। বিচারক বা আইনজীবী সবাই জানেন বহুল ব্যবহৃত সেই উক্তি – Justice delayed is justice denied' - বিলম্বিত বিচার বঞ্চনার নামান্তর। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রতিকারে সঠিক ব্যবস্থা বা পন্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েক বছর আগে সুপ্রিমকোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই.ভি.চন্দ্রচূড় একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, – ‘আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থায় এমন অনেক সহজাত সমস্যা আছে যা জনমানসে দীর্ঘস্থায়ী হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে বাধ্য। বিচার ব্যবস্থা ও কাঠামোর খুঁটিনাটি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে নানাবিধ বিধিনিয়ম প্রকরণের জন্য অতি মূল্যবান সময়ের অনেকটাই অপচয় হয়। এযাবৎ আইনের সংখ্যা যে অনুপাতে বেড়েছে, আইনের পরিধি যেভাবে বেড়েছে, আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা যে হারে বেড়েছে – সে অনুপাতে পদ্ধতি প্রকরণের সংস্কার করা হয়নি — সে অনুপাতে বিচারলয় ও বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি। সকলের সহযোগিতার অভাবে এবং নানাহ কারণে মামলার নিষ্পত্তি হতে দেরি হচ্ছে। যেভাবে জ্যামিতিক হারে অনির্ণীত সংখ্যা বাড়ছে, অদুর ভবিষ্যতে বিচার ব্যবস্থার উপরে সাধারণ মানুষের আস্থা কতটা থাকবে সেটাও ভাববার সময় এসেছে।



মামলার নিষ্পত্তি হতে দেরি হয় কেন?

প্রথমেই দেওয়ানি মামলার পদ্ধতি প্রকরণের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। মামলা দায়ের করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কোর্ট ফি দিয়ে যে কোনও আইনজীবীর মাধ্যমে আর্জি বা Plaint পেশ করলেই হলো। কিন্তু বিবাদী অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার উপর সমন জারি করাটা বিরাট ব্যাপার। সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে যথারীতি সমন যায়। বিবাদী সাধারণত সমন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেওয়ানি কার্যবিধির সমস্ত বিধান এক এক করে নিঃশ্বেস হওয়ার পরও এমনকি বিবাদীর বাসস্থানে লটকে জারি করেও যদি বিবাদী হাজির না হন তখন স্থানীয় কোন দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে বিবাদীর প্রতি নির্দেশ যাবে যথাসময়ে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য। এতেও যদি বিবাদী হাজির না হন, তখন উঠবে একতরফা শুনানির প্রশ্ন। সমস্ত বিধান এক এক করে নিঃশ্বেস করতে ইতিমধ্যে মামলা দায়েরের দিন থেকে প্রায় একবছর কেটে যাওয়া বিচিত্র নয়।



মামলার নিষ্পত্তি হতে দেরি হয় কেন?

প্রথমেই দেওয়ানি মামলার পদ্ধতি প্রকরণের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। মামলা দায়ের করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কোর্ট ফি দিয়ে যে কোনও আইনজীবীর মাধ্যমে আর্জি বা Plaint পেশ করলেই হলো। কিন্তু বিবাদী অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার উপর সমন জারি করাটা বিরাট ব্যাপার। সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে যথারীতি সমন যায়। বিবাদী সাধারণত সমন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেওয়ানি কার্যবিধির সমস্ত বিধান এক এক করে নিঃশ্বেস হওয়ার পরও এমনকি বিবাদীর বাসস্থানে লটকে জারি করেও যদি বিবাদী হাজির না হন তখন স্থানীয় কোন দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে বিবাদীর প্রতি নির্দেশ যাবে যথাসময়ে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য। এতেও যদি বিবাদী হাজির না হন, তখন উঠবে একতরফা শুনানির প্রশ্ন। সমস্ত বিধান এক এক করে নিঃশ্বেস করতে ইতিমধ্যে মামলা দায়েরের দিন থেকে প্রায় একবছর কেটে যাওয়া বিচিত্র নয়।

মামলা উঠলো একতরফা শুনানির জন্য। অকস্মাৎ বিবাদী এসে হাজির। অবশ্যই একতরফা শুনানির আদেশের বাতিলের জন্য আবেদন জানাবেন এবং সময়ও চাইবেন। এক্ষেত্রে সাধারণত সময় মঞ্জুর করা হয়ে থাকে। আদালতের নির্দেশে সময়ের মূল্যবাবদ বিবাদীকে হয়তো কিছুটা খরচ (cost) দিতে হতে পারে। কিন্তু বাদি তার সময়টা ফেরত পাবেন কি? পরবর্তী পর্যায়ে জবাব, প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত জবাব, মামলার মূল বিষয়বস্তু নির্ধারণ, নথিপত্র দাখিল এগুলি পরবর্তী পর্যায়ের কাজ। এতগুলো পর্যায় অতিক্রম করার পর শুনানির জন্য সম্ভাব্য দিন পড়বে। জেলা পর্যায়ের আদালতগুলিতে এতই মামলা জমে আছে যে প্রতিমাসে একটার বেশি তারিখ পাওয়া মুশকিল।

যাই হোক, শুনানিতে মামলা উঠতে কয়েকবছর লাগা বিচিত্র নয়। শুনানির সময় সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী উভয়পক্ষের সাক্ষীসাবুদ, নথিপত্র গৃহীত হয়। নির্ধারিত তারিখে সাক্ষি হাজির না হলে মামলা আবার পিছিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কখনও বিচারকের ছুটিতে থাকায়, কখনও উকিলবাবুর ব্যক্তিগত অসুবিধায় অনুপস্থিতি বা অন্য নানাহ কারণে হামেশাই মামলা মুলতুবি হয়। জমিজমা বা বাড়ির মামলায় সরেজমিন তদন্তের দরকার হয়। বর্গার মামলাতে বা অন্যান্য অনেক ব্যাপারে হস্তাক্ষর বিশেষজ্ঞের মতামত লাগে - দলিলের সই আসল কি নকল তা নির্ণয়ে। কিন্তু সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ইতিমধ্যে যে কোন পক্ষ তার আর্জি বা জবাব সংশোধনের আবেদন জানাতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে আপত্তি দাখিলের সময় দিতে হবে। অতঃপর শুধু সংশোধন আবেদন শুনানির জন্য তারিখ নির্দিষ্ট হবে। এক্ষেত্রেও অনেকটা সময় চলে যেতে পারে। শুনানির শেষ পর্যায়ে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল, জবাবি সওয়াল। তারপর বিচারক রায় দেবেন। এই শেষ পর্যায়ে দেখা গেল বিচারক অন্যত্র বদলি হয়ে গেলেন। তারপর প্রতীক্ষায় বসে থাকা কবে আরেকজন বিচারক আসবেন। পরবর্তী বিচারক এসে রায় দেবেন ঠিকই কিন্তু তিনি তা দেবেন নথিপত্র দেখে। কিন্তু সাক্ষীদের আচার, আচরণ, বাদি-বিবাদীর আচার আচরণ প্রত্যক্ষ না করেই। বিচারক রায় দিলেন। বাদি বা বিবাদী একপক্ষ আপিলে উচ্চতর আদালতে যেতেই পারেন। নিম্ন আদালত থেকে জেলা আদালত, জেলা আদালত থেকে হাইকোর্ট তাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

প্রচলিত আছে 'Real trouble begins with the decree.'। মামলায় জিতে ডিক্রী পেলেন, শুরু হলো অন্য যন্ত্রণা। ডিক্রী পেয়ে জারী না করলে ডিক্রী নিরর্থক। কিন্তু ডিক্রী জারিও তদ্বির সাপেক্ষ। ডিক্রী জারি করতে ‘বেইলিফ' পেয়াদার উপর নির্ভর করতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় বেইলিফদের সংখ্যা কম। কাজেই ডিক্রী জারি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেক সময় কিছু কিছু মামলা জজ কোর্ট, জেলা আদালত বা হাইকোর্টে রিভিশন হিসেবে যায়। উচ্চ আদালত মাঝে মাঝে নিচের আদালতের মামলা ফেরত পাঠান পুনর্বিবেচনার জন্য। তাতে সময় যায় অনেক। বিচারক মানুষ হলেও অবশ্যই যন্ত্র নন এবং আইনের ব্যাখ্যা শুনে তার রায় লেখা কোন সাধারণ কাজ নয়। আইনের ভাষা সাধারণের ভাষা নয়। নথি পেয়ে কোথাও কমা বা ফুলস্টপ স্থানচ্যুত হলেই অর্থ বদলে যাবে। সুতরাং বিচারককে সবসময় সতর্ক হয়ে অগ্রসর হতে হয়।

ফৌজদারী মামলাও চলে বছরের পর বছর। পুলিশ থেকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কেইস ডায়েরি দিতে দেরি হয়। অভিযোগের নকল দিতে দেরি হয়। সাক্ষীসাবুদ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সময় চাওয়া হয়। পুলিশের ভয়ে আগ বাড়িয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে চান না। তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দাখিল করতে অনেক ক্ষেত্রে ২/৩ বছর লেগে যায়। এমনও অসংখ্য নজির আছে যার সর্বস্ব চোরে নিয়ে গেছে – বছরের পর বছর ঘুরে তিনিও হতাশ হয়ে আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছেন। দেরির পরিণতি হয় আরও মারাত্মক। এমনও দেখা গেছে যে, কোনও চুরি বা ডাকাতির মামলা দশ বছরেও নিষ্পত্তি হলো না। চোরাই মাল পুলিশের মালখানায় অযত্নে থেকে ব্যবহারের অযোগ্য, এমনকি চেনার অযোগ্য হয়ে গেল। যার গেল তার গেল। তাছাড়া আদালতের কাজকর্মে পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। যিনি মামলার তদন্তকারী অফিসার তাকে আবার আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকতে হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ পেয়েও শুনানির দিন Law and order এর কারণ দেখিয়ে অনেক সময় IO বা যিনি FIR নথিভুক্ত করেছেন তারা আদালতে হাজির হন না। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে এদের সাক্ষ্য খুব জরুরি। খুব স্বাভাবিক সরকারি উকিলবাবু সময় চাইবেন। মামলা পিছিয়ে যায়। বস্তুত পুলিশ বিভাগে মামলা দ্রুত তদন্তের জন্য আলাদা কোন Investigating wing না থাকায় চার্জশীট বা ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করতে অনেকটাই দেরি হয়।

পুলিশের হাতে অনেক ক্ষমতা। আদালত যে ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করতে বলবেন, পুলিশ না চাইলে তাকে কিছুতেই পাওয়া যাবে না । পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু তা কার্যকরী করবে কে? আসলে ইংরেজ আমলে তৈরি আইনে পুলিশের হাতে অনেক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন দমন করার জন্য। সম্প্রতি CRPC, IPC and Evidence Act এর জায়গায় নতুন করে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এগুলিও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। যাই হোক ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে এই নতুন আইনের কার্যকারিতা। আইনের অপপ্রয়োগ ঘৃণ্যতম অপরাধ। আইনের অপপ্রয়োগের ফলে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল। — জুডিশিয়াল মার্ডারের জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বিচারক, আইনজীবী তথা প্রত্যেকটি দায়িত্বশীল নাগরিককে সদাসতর্ক থাকতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই আইনের অপপ্রয়োগ না হয়।

পুলিশ হেপাজতে বন্দী নির্যাতন এবং নির্যাতনের পরিণতিতে মৃত্যুর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। মানবাধিকারের জন্য যারা সংগ্রাম করে চলেছেন তারা প্রকৃত সংখ্যার হিসাব দিতে পারবেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের কথা পুলিশ হেপাজতে বন্দীর মৃত্যুর জন্য কারো সাজা এদেশে হয়েছে বলে খুব একটা শোনা যায়নি। তবে কয়েক বছর পূর্বে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে ফৌজদারী অধিক্ষেত্রে একটি মামলার রায় দেবার সময় মাননীয় বিচারপতি এ.এম আহমদী ও মাননীয়া বিচারপতি ফাতিমা বিবি অভিমত প্রকাশ করেন যে, পুলিশ হেপাজতে বন্দীর মৃত্যু হলে তার দায় পুলিশকে নিতে হবে। পুলিশের লকআপে কয়েদী হত্যার প্রবণতা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারক একই ব্যক্তি। দায়রা মামলায় যেহেতু অভিযুক্তের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত সেইহেতু জেলা ও দায়রা জজের কাছে দায়রা মামলা অগ্রাধিকার পায়। সুতরাং দেওয়ানি মামলা ঝুলে থাকে। অনেকেরই ধারণা উকিলবাবু অথবা বিচারকরা মামলা দেরি করছেন। এ ধারণা ঠিক নয়। বিচারকদের কাজের বোঝা যতটা বেড়েছে সেই অনুপাতে আদালত কর্মী ততটা বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মামলা দায়ের করেই মক্কেল বেপাত্তা। যোগাযোগ না করলে উকিলবাবুরা মামলায় স্টেপস্ অর্থাৎ বিভিন্ন করণীয় করবেনই বা কেন? মামলা ঝুলে থাকে।

প্রশাসনিক অবিচার, অত্যাচার, অন্যায়ের কারণেও অযথা অনেককে আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত কোন আক্রোশে সরকারি অর্থ ব্যয়ে উপরওয়ালা অধঃস্তন কোন সহকর্মীকে হয়রান করলেন ঠিকই। সব শেষে দেখা যাবে প্রাপ্য ২৫ হাজার টাকা ঠেকাতে সরকারি তহবিলের এক লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে। নীতির প্রশ্নে সাফাই গাইলেও ব্যাপারটা গোটা সমাজব্যবস্থা তথা বিচারব্যবস্থাকেও নাড়া দিচ্ছে। চাকরি সংক্রান্ত মামলা রোজই বাড়ছে। আদালতের তলব মতো নথিপত্র সরকার থেকে একবারে কখনই দাখিল করা হয় না। দেরি হয়, সবাই ব্যস্ত। সর্বোপরি Adjournment সঙ্গত বা অসঙ্গত কারণে মামলার মুলতুবি—মামলার নিষ্পত্তি অনেকটা পিছিয়ে দেয়।

আমাদের বিচার ব্যবস্থায় একাধিক আপিল আদালত আছে। দ্বিস্তর আপিল আদালতের বিষয়ে একটা অনুমান করা যেতে পারে। যদি প্রথম আপিল আদালতটি পরবর্তী বা চূড়ান্ত আপিল আদালত থেকে উৎসৃষ্ট হয়, তাহলে পরবর্তী বা চূড়ান্ত আপিল আদালত রাখার দরকার কি? আবার যদি চূড়ান্ত আপিল আদালতই বিচার বিবেচনার জন্য অধিক উপযুক্ত হয়, তবে প্রথম আপিল আদালতটা রাখাই বা কেন? প্রথম অনুমানটি ঠিক হলে আপিল উৎসৃষ্ট আদালত থেকে নিকৃষ্টমানের আদালতে যাচ্ছে। আর যদি দ্বিতীয় অনুমানটি ঠিক হয়, তাহলে বিচার প্রার্থীকে পদ্ধতিগতভাবে বাধ্য করা হচ্ছে একটি নিরেশ আদালত হয়ে উৎসৃষ্টমানের আদালতে যেতে। আবার আপিলের দুটি আদালতই যদি সমান ভালো হয়, তাহলে যে কোনও একটাই থাক না – দুটি রাখার কোন আপাত স্বার্থকতা নেই। Lord Atkin আপিল আদালতের বিচার প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, শতকরা ৩৩টা মামলার রায় প্রথম আপিলে উল্টে যায়। আবার দ্বিতীয় আপিলে সমশতাংশ রায় পাল্টে যায়। কাজেই দ্রুত ন্যায়বিচার পেতে গেলে এই দিস্তর আপিল আদালতের বিষয়ে কিছুটা সংস্কার সাধন করা যেতে পারে।

আমরা সবাই চাই আদালতের সম্মান এবং মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকুক এবং বাড়ুক। এই মর্যাদা বিচারকের নয়, বিচারব্যবস্থার। বিচারককে যেটুকু সম্মান দেখানো হয় সেটা ব্যক্তিগত কোন কারণে নয়। সমাজের প্রয়োজনে দেখা দরকার যাতে বিচারক নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় আইন ও নিজের বিবেককে মেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এও দেখা দরকার যে সেই বিচারে সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে। বিচারের কাজে কোনপ্রকার অন্যায় হস্তক্ষেপ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক। আদালতের সম্মানের প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই আদালতের সম্মানহানির ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এই ব্যাপারে কোন সুস্থ কনভেনশন গড়ে উঠেনি। তাই বিচার চলাকালীন কাগজপত্রে এমন অনেক কথা লেখা হয় যা লেখা অনুচিত, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিচারব্যবস্থায় ধরেই নেওয়া হয় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নিরপরাধ বলেই মানতে হবে।

আদালত অবমাননার প্রশ্ন নিয়ে অনেক ভুল ধারণাও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে। বিচার চলাকালীন কোন কোন মন্তব্য নিশ্চয়ই আদালতের কার্য পরিচালনায় অন্যায় হস্তক্ষেপ। বিচারের রায় দেওয়ার পর বিচারকের উপর কোন উদ্দেশ্য আরোপও অসংযত এবং অবমাননামূলক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিচারের পদ্ধতি বা রায়ের সমালোচনা হতে পারবে না। গঠনমূলক সমালোচনারও ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন রয়েছে। সমালোচনা না হলে অন্য দশটা জিনিসের মতো বিচার ব্যবস্থায়ও উন্নতি হবে না। বিচারক ভুল করেছেন বলার অর্থ এই নয় যে বিচারক ইচ্ছে করেই কিছু অন্যায় করেছেন। যে কোনও বিচারেই ভুল থাকতে পারে এবং তার স্বীকৃতি রয়েছে আপিলের ব্যবস্থায়। আপিলে অনেক সময়ই নিচের আদালতের রায় পাল্টে যায়।

বিচারকের অধিকার রয়েছে যে কোন স্থানে কোর্ট বসিয়ে Injunction জারি করা। নিজের বাড়িতেও সেটা হতে পারে। একতরফাও দেওয়া চলে। Injunction মানেই হলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখা তেমনই থাকলো, যতক্ষণ না মূল মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে যেমনটি যেমন রয়েছে ইতিমধ্যে কোনওরকম কিছু পরিবর্তন চলবে না। কিন্তু এই স্থিতাবস্থার কি লাভ আছে? এই দীর্ঘসূত্রিতা সাধারণ মানুষের স্বার্থে আসে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে Injunction জারির ফলে জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। একটা জরুরি, বিশেষ ব্যবস্থা বা ব্যতিক্রম হিসেবে Injunction জারি করা উচিত কেউ যেন না ভাবে যে কোনমতে একজন ভালো উকিলবাবু ধরে আদালতে দাঁড়ালেই কোন কাজ বা ব্যবস্থা বন্ধ করে - তা যেন নিয়ম না হয়ে দাঁড়ায়। দেওয়া যাবে। এছাড়া Injunction জারি করার সময় সাংগঠনিক লাভক্ষতির হিসাবটাও করা দরকার। একজন মানুষের লাভের পাশাপাশি আরও কত মানুষের ক্ষতি হলো - কত কাজ হতে গিয়ে বাধা পড়লো, কত বেকার চাকরি পেতে গিয়ে পেল না, কত জায়গায় কাজ না করিয়েও মোটা টাকার মাইনে গুণতে হলো। Injunction এর ব্যাপারে একটা স্পষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার যাতে বাড়াবাড়ি না হয়, এই সুযোগের অপব্যাখ্যা না হয়।

আইনের বিধান অনুযায়ী ফৌজদারী মামলা ও দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সরকারের আইনগত ভূমিকার কিছুটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ ফৌজদারী মামলা আদালতে বিচারের জন্য গৃহীত হলে তার পরিচালনার ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হয়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে দোষী ব্যক্তির শাস্তি কার্যকর করার দায়িত্বও সরকারের। কিন্তু কোন দেওয়ানি মামলা আদালতে বিচারের জন্য গৃহীত হলেও তার পরিচালনার ব্যয়ভার যিনি মামলা দায়ের করেছেন তাকেই বহন করতে হয়। এমনকি কোন প্রতিপক্ষ দেওয়ানি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলেও তার শাস্তি কার্যকর করার ব্যয়ভার বাদীকেই বহন করতে হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। তাদের পক্ষে আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। দরিদ্র মানুষের আইনগত সুযোগ সুবিধার জন্য যদিও কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। আইন, বিচার দরিদ্র জনসাধারণের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। ফৌজদারী ও দেওয়ানি মামলায় সরকারের আইনগত ভূমিকার ক্ষেত্রে কিছুটা সমতা আনা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার।

আরেকটা ভাববার দিক সংবিধানের ক্ষমতা বিভাজনের প্রশ্নে। আইন প্রণয়ন, বিচার এবং প্রশাসনের মধ্যে কাজকর্মের একটা ভাগ রয়েছে। এই বিভাজন ঠিকমতো নাহলে এবং এনিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বিচারবিভাগকেও ভাবতে হবে যেন অন্য দুই শাখার সঙ্গে কোন বিরোধে কেউ টেনে আনতে না পারে। কোন কোন সমালোচকের মন্তব্য বিচারবিভাগকে দলীয় রাজনীতি প্রভাবিত করছে। কেউ বলবে না যে, বিচারকরা কোন দলীয় রাজনীতির শিকার হবেন এবং নিশ্চয়ই তা হন না। নিশ্চয়ই বিচারকরা এই সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেদের চিন্তা এবং বিচার বিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানেও আইনের জগতের আরেকটা মূল্যবান কথার উল্লেখ প্রয়োজন ‘Justice not only be done, but must be shown to have been done'। বিচার সঠিক হলেই শুধু চলবে না, লোকে যেন বুঝতে পারে সত্যি সত্যিই সঠিক বিচার হয়েছে।

এটা প্রায়শই দেখা যায় যে, অগত্যা বাধ্য না হলে বিশেষ করে ফৌজদারী আদালতের ত্রিসীমানায় কেউ আসতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তাবোধের অভাবে সাক্ষীরা সত্য সাক্ষ্য দিতে ভয় পান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে খুব কম লোকই এগিয়ে আসেন যাতে অপরাধীর শাস্তি হয়। পরিণামে জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও বেকসুর খালাস পায়। সুতরাং মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। কারো নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।



উপসংহার

যাতে সত্য সাক্ষ্য দিতে গিয়ে

সম্প্রতি মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের ২১ জন প্রাক্তন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে চিঠি লিখেছেন তাদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে এবং তার প্রতিবিধানের জন্য – ‘সংকীর্ণ রাজনৈতিক মানসিকতায় ব্যক্তিগত স্বার্থে দেশের বিচারব্যবস্থার আস্থা নষ্টের চেষ্টা চলছে। ফেইক নিউজ ও চরিত্র হরণের মতো পন্থা অবলম্বন করে মানুষের মনে বিচারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এহেন ঘটনায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। মিথ্যা ও ভুল তথ্য তুলে ধরে বিচারব্যবস্থার প্রতি দেশের জনগণের তথা সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ নষ্টের চেষ্টা চলছে। এই ঘটনা শুধু অনৈতিক নয় গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির জন্য ক্ষতিকর। এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা বিচার বিভাগের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে প্রস্তুত। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বিচারবিভাগকে বাঁচাতে হবে। বিচারবিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য কিছু মানুষের নিজেদের মনগড়া গল্প তৈরি করে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।' মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতিদের এই আশঙ্কা ও উদ্বেগ বিশেষ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করা দরকার।

সবশেষে উল্লেখ প্রয়োজন উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি যাতে বিচারকের আসনে আসীন হন, সেদিকে যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া দরকার। বিচারের উৎকর্ষ বহুলাংশে বিচারকের উপযুক্ততার উপর নির্ভর করে। এই জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিচারকের পদটি আরও আকর্ষণীয় করে তোলা – যাতে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা বিচারবিভাগের প্রতি আকৃষ্ট হন। আর প্রয়োজন বিচারকরা যাতে নির্ভয়ে পক্ষপাতশূন্য বিচারকার্য চালিয়ে যেতে পারেন। তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। আদালতের সহায়তা করার দায়িত্ব সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন সব নাগরিকের। বিশেষ করে কোন শ্রেণিকে চিহ্নিত করে দায় চাপানো অর্থহীন। নতুবা বিচারব্যবস্থা ও আদালতের উপরে সামগ্রিকভাবে আস্থা হারাতে বাধ্য হবেন আইন মেনে চলা নাগরিকেরা। কেউই বাদ যাবো না অরাজকতা মাৎসন্যায়ের কবল থেকে। তাই যদি হয়, তবে শেষের দিনগুলি হবে আরও ভয়ঙ্কর।


You can post your comments below  
নিচে আপনি আপনার মন্তব্য বাংলাতেও লিখতে পারেন।  
বিঃ দ্রঃ
আপনার মন্তব্য বা কমেন্ট ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লিখতে পারেন। বাংলায় কোন মন্তব্য লিখতে হলে কোন ইউনিকোড বাংলা ফন্টেই লিখতে হবে যেমন আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড (Avro Keyboard)। আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ডের সাহায্যে মাক্রোসফট্ ওয়ার্ডে (Microsoft Word) টাইপ করে সেখান থেকে কপি করে কমেন্ট বা মন্তব্য বক্সে পেস্ট করতে পারেন। আপনার কম্পিউটারে আমার বাংলা কিংবা অভ্রো কী-বোর্ড বাংলা সফ্টওয়ার না থাকলে নিম্নে দেয়া লিঙ্কে (Link) ক্লিক করে ফ্রিতে ডাওনলোড করে নিতে পারেন।
 
Free Download Avro Keyboard  
Name *  
Email *  
Address  
Comments *  
 
 
Posted comments
Till now no approved comments is available.